নিজস্ব প্রতিনিধি আগরতলা।
রাজধানী আগরতলার বর্ডার গোলচক্কর সংলগ্ন এলাকায় রবিবার রাতের ঘটনাপ্রবাহ যেন শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার নগ্ন চিত্র ফুটিয়ে তুলল। একদিকে পুলিশের উপস্থিতি, অন্যদিকে প্রকাশ্য মারধর, অপহরণ ও ভাঙচুর — সব মিলিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, রাজধানীর বুকে এমন দুঃসাহসিক ঘটনা ঘটার পরও আইন-শৃঙ্খলা বলে কিছু অবশিষ্ট আছে কি? গত কয়েক মাস ধরেই ওই এলাকায় মাফিয়া চক্রের দৌরাত্ম্য নিয়ে ক্ষোভ জমছিল স্থানীয়দের মনে। বাজারের ব্যবসায়ী থেকে পথচারী — সকলেই একপ্রকার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছিলেন। রবিবার রাতের ঘটনাই যেন সেই আতঙ্কের বাস্তব রূপ। অভিযোগ, স্থানীয় যুবক ইফরান খানকে প্রকাশ্যে দোকান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে মারধর করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন স্থানীয় এক বিজেপি বুথ সভাপতিও। এমন অভিযোগে স্বাভাবিকভাবেই তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
ইফরানের অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাবে পরিচালিত ওই গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরেই এলাকায় চাঁদাবাজি ও দমননীতি চালিয়ে আসছে। ব্যবসা করতে হলে ‘তাদের অনুমতি’ নিতে হয়। প্রতিবাদ করলে হামলার মুখে পড়তে হয়। শনিবারই এক ব্যবসায়ীকে পিস্তল দেখিয়ে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। স্থানীয়রা পশ্চিম আগরতলা থানায় অভিযোগ করলেও পুলিশ নাকি কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি — এই অভিযোগই এখন তীব্রভাবে ঘুরছে এলাকাজুড়ে। রবিবার রাতের ঘটনায় একাধিক দোকান ও মোটরবাইক ভাঙচুরের পাশাপাশি দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয় পুলিশের উপস্থিতিতেই। আইনরক্ষকদের চোখের সামনেই আইন ভঙ্গ — এমন চিত্রে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন, “যদি রাজধানীর মাঝখানেই পুলিশের সামনে এমন ঘটনা ঘটে, তবে সাধারণ মানুষ কোথায় নিরাপদ?”
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাতেই ঘটনাস্থলে পৌঁছান পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার পুলিশ সুপার নমিত পাঠক। মোতায়েন করা হয় বিশাল পুলিশ ও টি.এস.আর বাহিনী। পরে আগমন ঘটে স্থানীয় বিধায়ক তথা আগরতলা পুরনিগমের মেয়র দীপক মজুমদারের। তিনি উভয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলে শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানান। তবু ক্ষোভ থামেনি নাগরিক সমাজে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, “রাজনৈতিক ছত্রছায়া ছাড়া এমন বেপরোয়া আচরণ সম্ভব নয়।” রাজনৈতিক আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা সমাজবিরোধীরা এখন যেন প্রশাসনের মাথাব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাঁদাবাজি, হুমকি, হামলা — সবই চলছে প্রকাশ্যে, অথচ প্রশাসন যেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়।বিগত কয়েক বছরে রাজ্যের রাজধানীতে মাফিয়া কার্যকলাপের প্রসার ঘটেছে উদ্বেগজনক হারে। রাতের অন্ধকারে নয়, এখন দিনের আলোতেও চলছে দৌরাত্ম্য। একাংশের মতে, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধুর সম্পর্কই এই দুঃসাহসের মূল কারণ। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা যেন আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
এলাকার প্রবীণ নাগরিক কাজী রাজিব মিয়া বলেন, “আমরা থানায় বারবার অভিযোগ জানিয়েছি, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। পুলিশ শুধু আশ্বাস দেয়, কাজের কাজ কিছুই করে না। এখন আর কেউ মুখ খোলার সাহস পায় না।”
এই ঘটনায় রাজ্যের বিরোধী দলগুলিও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছে। তাদের বক্তব্য, “শহরের কেন্দ্রে এমন আইনভঙ্গের ঘটনা রাজ্যের ব্যর্থ আইনশৃঙ্খলারই প্রমাণ।”
বর্তমানে এলাকায় আপাত শান্তি ফিরলেও মানুষের মনে ভয় ও অবিশ্বাস গেড়ে বসেছে। রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা ও পুলিশের দুর্বলতা — এই ত্রিমুখী বাস্তবতা যেন আগরতলার ভবিষ্যৎ আইন-শৃঙ্খলার জন্য এক অশুভ সংকেত। রাজধানীর মাফিয়া রাজনীতি এখন শুধু নিরাপত্তাকেই নয়, ন্যায়বোধকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। প্রশাসন কি এবার জাগবে, নাকি নাগরিকের আস্থাই হবে পরবর্তী বলি — সেই প্রশ্নই এখন আগরতলার প্রতিটি মুখে।