
Oplus_131072
প্রতিনিধি অনুপম পাল
কৈলাসহর, ঊনকোটি ত্রিপুরা
সকাল গড়িয়ে দুপুর। পূর্ব রৌয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নয়দ্রোন এলাকায় তখনও চেনা দিনের ব্যস্ততা। মাঠের পাশ দিয়ে পায়চারি করতো বেরিয়েছিলেন কয়েকজন গ্রামবাসী। হঠাৎই কানে এলো অদ্ভুত এক শব্দ—কোনো এক ছোট্ট প্রাণের করুণ আর্তনাদ।
প্রথমে কেউ বুঝতে পারছিলেন না, কোথা থেকে আসছে এই কান্না। একে একে জড়ো হলেন নরোত্তম, অরুণ,সুজাতা ও রতন। চারপাশে খুঁজতে গিয়ে হঠাৎই একটি ঝোপের আড়ালে দেখা গেল—একটি ছোট্ট নবজাতক কন্যা, রোদে পুড়ে অশ্রুসিক্ত, জীবনের আশায় ছোট্ট দুটি হাত নেড়ে যাচ্ছে।
কে ফেলে গেল তাকে? কোন হৃদয়হীনতা, কোন ভয়, কোন অভিশাপ তাকে মাতৃক্রোড় থেকে বিচ্ছিন্ন করল? মুহূর্তের মধ্যেই জমে গেল ভিড়। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলেন, “হয়তো অবৈধ সম্পর্কের ফসল, তাই ফেলে দিয়েছে!” আবার কেউ বললেন, “হয়তো শুধুমাত্র কন্যাসন্তান জন্মানোর অপরাধেই এই নিষ্পাপ শিশুকে এমন নির্মম পরিণতির শিকার হতে হলো!”
কিন্তু এসব যুক্তি দিয়ে কি একটি প্রাণের মূল্য কমে যায়? স্থানীয়দের তৎপরতায় শিশুটিকে জ্বলেবাসা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকরা নবজাতক সেই শিশু কন্যাটিকে কিছুক্ষণ দেখে জানালেন—সে একেবারে সুস্থ, শুধু ক্ষুধার্ত! যেন প্রকৃতি নিজেই তার রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যেন সূর্যের আলোয় সে নতুন করে জন্ম নিল।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে, আমরা যেখানে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার গল্প করি, সেখানে আজও জন্মের পর কন্যাসন্তানকে ফেলে যাওয়া হয়! কেউ হয়তো বলবে, “সে অবৈধ সম্পর্কের ফসল!” কিন্তু যদি তাই হয়, তাহলে কি দায় শুধু মায়ের? সমাজ কি শুধুই নারীর ওপর সবকিছুর বোঝা চাপিয়ে দেবে?
কন্যাসন্তান কোনো অভিশাপ নয়, কোনো বোঝা নয়। সে-ও একদিন কারো মা হবে, সমাজের আলো হয়ে উঠবে। তাকে জন্মের পরই ফেলে দেওয়ার মানসিকতা যদি বদলাতে না পারি, তবে সভ্যতার কী মূল্য?
আজ নয়দ্রোনের সেই মাঠ সাক্ষী থাকল এক নিষ্পাপ শিশুর কান্নায়, আবার মানবতার আলোতেও। যে হৃদয়হীন হাতে তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, তার বিপরীতে কয়েকজন উদার হৃদয়ের মানুষ প্রমাণ করলেন—মানবতা এখনো মরে যায়নি!
এই শিশুটি আজ বেঁচে আছে।
সে বাঁচবে। ভালোবাসার স্পর্শে, কোনো স্নেহশীল হৃদয়ে, সমাজের নতুন আলোতে।একদিন হয়তো সে-ই বলবে—
জন্ম নিয়েছিলাম, আলো দেখিনি,
শুধু কেঁদেছিলাম, কেউ শুনলো কি?
শুধু এই পাপে, আমি কন্যা,
তাই কি ফেলে গেলে, মা?
নিঃসঙ্গ ঝোপে, রোদ্দুরের ছায়ায়,
অভিশপ্ত কি আমি, সমাজের দায়ে?
কিন্তু শুনেছিল কিছু মানুষ,
তারা যে ভালোবাসতে জানে!
তারা তুলেছিল, দিয়েছে আশ্রয়,
বুকে টেনে নিয়ে বলেছিল—”ভয় নেই!”
আজ আমি বেঁচে আছি,
আগামীর আলো হতে চাই!