
Oplus_131072
প্রতিনিধি অনুপম পাল
কৈলাসহর,ঊনকোটি ত্রিপুরা
ইতিহাস, যা অতীতের কাহিনী বয়ে আনে বর্তমানের আলোকে, তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠে এসেছে দেওড়াছড়ার ভূঁইঞা পাড়া। মাটির গভীরে লুকিয়ে থাকা এক প্রাচীন নিদর্শনের রহস্যোদঘাটন হলো এই গ্রামে।
সকালবেলার সূর্য তখনো ঠিকমতো নিজের জ্যোতি ছড়ায়নি। দেওড়াছড়ার ৪ নম্বর ওয়ার্ডে চলছিল মাটি খননের কাজ। সাধারণ দিন, সাধারণ কর্ম, কিন্তু সেই সাধারণের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল অতীতের এক অমূল্য সম্পদ। শ্রমিকদের হাতে এক মুহূর্তে বদলে গেল সেই দৃশ্যপট। মাটির নিচ থেকে উঠে এলো এক বিশাল পাথরের মূর্তি। গ্রামবাসীর চোখে বিস্ময়, হৃদয়ে প্রশ্ন—এ মূর্তি কার?
মূর্তিটির দৈর্ঘ্য ৯০ সেন্টিমিটার, প্রস্থ ৫৩ সেন্টিমিটার, ওজন প্রায় ২০০ কেজির বেশি। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে অনেকের ধারণা এটি নবম শতকের। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ একে দেবতা ব্রহ্মার মূর্তি বলছেন।
ঘটনার খবর দ্রুত প্রশাসনের কাছে পৌঁছতেই তড়িঘড়ি ছুটে আসেন,মহকুমা শাসক প্রদীপ সরকার ও গৌরনগর আরডি ব্লকের বিডিও প্রণয় দাস। তাদের সঙ্গে ছিলেন আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ঊনকোটি জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংরক্ষণ সহকারী অভিষেক কুমার। মাটি খনন করে মূর্তিটিকে উদ্ধার করা হয় এবং প্রাথমিক নিরাপত্তার জন্য তা প্রশাসনের হেফাজতে রাখা হয়।
উদ্ধারকৃত মূর্তিটি বর্তমানে গৌরনগর আরডি ব্লকের বিডিও প্রণয় দাস আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ঊনকোটি জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংরক্ষণ সহকারী অভিষেক কুমারের কাছে হস্তান্তর করেছেন।
সংরক্ষণ সহকারী অভিষেক কুমার বর্তমানে মূর্তিটিকে শৈবতীর্থ ঊনকোটিতে রেখেছেন বলে জানা গেছে। ঊনকোটি, যা নিজের প্রাচীন শৈব প্রতিমা ও ভাস্কর্যের জন্য বিখ্যাত, সেখানে এই মূর্তি নতুন আলো জ্বালাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করছেন, এই মূর্তি প্রাচীন সময়ের ধর্মীয় বিশ্বাস ও স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন।
উদ্ধারকৃত মূর্তি শুধু একটি শিল্পকর্ম নয়, এটি আমাদের সভ্যতার অতীত ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী নবম শতকের এই মূর্তিতে সমকালীন সমাজের বিশ্বাস, শৈল্পিক দক্ষতা, এবং আধ্যাত্মিক চেতনার ছাপ স্পষ্ট।
দেওড়াছড়ার এই ঘটনা প্রমাণ করে যে কৈলাসহরের মাটির নিচে লুকিয়ে আছে আরও অনেক অজানা গল্প। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার মধ্য দিয়ে এগুলোকে খুঁজে বের করা আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার দায়িত্ব বলে মনে করছেন মহকুমাবাসী। সময়ের পরিক্রমায় এই মূর্তি যেন এক সেতু হয়ে উঠে—অতীত ও বর্তমানের মধ্যে। এটি শুধু একটি শিল্পকর্ম নয়, বরং এটি ইতিহাসের স্রোতে এক অমূল্য স্মারক, যা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে।
কৈলাসহরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং ঐতিহ্যের অমোঘ বর্ণনাকারী তথা রাজ্যের প্রিয় লেখক সত্যজীত দত্ত, দেওড়াছড়া এডিসি ভিলেজের ভূঁইয়াপাড়া থেকে উদ্ধার হওয়া প্রাচীন ব্রহ্মার মূর্তিকে ঘিরে তার মূল্যবান মতামত শুধুমাত্র আমাদের ভবিষ্যত প্রতিনিধির কাছে তুলে ধরেছেন। তার মতে, এই মূর্তিটি কেবল এক প্রাচীন নিদর্শন নয়, বরং ঊনকোটির শিল্পধারায় নতুন দিক উন্মোচনের ইঙ্গিত বহন করছে।
তিনি বলেন, “ঊনকোটির শিল্পকলায় আমরা বরাবরই পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা মূর্তি এবং ত্রিমাত্রিক দাঁড়ানো মূর্তির সংমিশ্রণ দেখেছি। খোদাই করা মূর্তিগুলির তুলনায় ত্রিমাত্রিক মূর্তিগুলোর শৈল্পিক কারুকাজ বরাবরই ছিল সূক্ষ্ম এবং নিখুঁত। তবে আজ উদ্ধার হওয়া মূর্তিটিতে এই দুই শৈল্পিক ধারার এক অপূর্ব সমন্বয় দেখা যাচ্ছে। যদিও এই মূর্তির শৈল্পিক মান কিছুটা কম বলে মনে হচ্ছে, এটি আমাদের ঐতিহ্য এবং শিল্পচর্চার এক নতুন অধ্যায়ের দ্বার উন্মোচন করতে পারে।”
সত্যজীত দত্ত আরও যোগ করেন, “যদি এই মূর্তিটি ঊনকোটি নির্মাণের সময়কার হয়, তবে আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে এতদিনকার ধারণাগুলো নতুন আলোকে বিচার করতে হবে। ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ যদি মূর্তিটি নিয়ে গভীর গবেষণা করে, তবে আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির আরও অনেক অজানা অধ্যায় সামনে আসতে পারে।”
ঊনকোটির ত্রিমাত্রিক মূর্তির সূক্ষ্ম শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য এবং খোদাই করা মূর্তির গভীরতাকে একত্রিত করে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচনের এই সম্ভাবনা কৈলাসহরের শিল্প-ঐতিহ্যের মহিমাকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলেছে।