
প্রতিনিধি অনুপম পাল, ধর্মনগর
অষ্টমীর রাত—চারদিক তখন উৎসবের আলোয় ভাসছে। শঙ্খধ্বনি, ঢাকের তাল, আলো ঝলমলে প্যান্ডেল ঘুরে মুগ্ধ চোখে দেখছে ছোটরা। ধর্মনগরের স্বর্ণময়ী লেনের অভিজিৎ দেবনাথও সেই রাতেই ছেলেকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন পুজো দেখতে। ছোট্ট অভিরূপ—মাত্র ১১ বছর বয়স। চোখে একরাশ উচ্ছ্বাস, হাতে বাবার হাত। কে জানত, সেটাই হবে বাবা-ছেলের শেষ একসঙ্গে পুজো দেখা। দীঘলবাঁক এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার সময় হঠাৎ পিছন দিক থেকে ছুটে আসে একটি সাদা রঙের ওয়াগন-আর গাড়ি (নম্বর TR-05-D-0436)। মুহূর্তের মধ্যে ধাক্কা মারে বাবা-ছেলেকে। বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে আশেপাশের এলাকা। রক্তে ভেসে পড়ে রাস্তা। ছিটকে পড়ে যান অভিজিৎ দেবনাথ ও তাঁর ছেলে অভিরূপ। চালক গাড়ি থামায়নি—চুপিচুপি পালিয়ে যায়।স্থানীয়রা ছুটে এসে দু’জনকেই ধর্মনগর জেলা হাসপাতালে পাঠান। অভিজিতের হাত ভেঙে যায়, কিন্তু অভিরূপের অবস্থা ছিল আরও গুরুতর। চিকিৎসকেরা জানান—তার লিভার ফেটে গেছে, শরীর জুড়ে গভীর ক্ষত। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে বহিঃরাজ্যের এক বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। চারদিন ধরে আইসিইউ-তে চলতে থাকে লড়াই—একদল চিকিৎসক, একদল অভিভাবক, আর অজস্র প্রার্থনা। কিন্তু অবশেষে ১১ বছরের নিষ্পাপ মুখটি হেরে গেল জীবনের কাছে।
মায়ের পুজো দেখা শেষ হয়নি, অথচ শেষ হয়ে গেল একটি কোমল জীবনের পথচলা। এখন সেই বাড়িতে নেই আর হাসির শব্দ, নেই ছেলের “মা, ওই প্রতিমাটা দ্যাখো!”—বাক্যটি। আছে শুধু নীরবতা, শোক আর চোখের জল।
অভিজিত দেবনাথের পরিবার জানায়, চালক সৌভিক নাথ (৩৪), বাড়ি নেতাজি পল্লীতে। অষ্টমীর রাতে সে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালাচ্ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি। সেই বেপরোয়া নেশাই কেড়ে নিল এক শিশুর প্রাণ।ঘটনার পর অভিজিত বাবুর পরিবারের পক্ষ থেকে ধর্মনগর থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। তদন্তকারী আধিকারিক জানিয়েছেন, অভিযুক্ত সৌভিক নাথের বিরুদ্ধে ২৮১/১২৫/বি/বিএনএস এবং ১৮৪/১৮৭ এমভিএ ধারায় মামলা নথিভুক্ত করা হয়েছে (মামলা নং ৮৭/২৫)। তবুও এখনো পলাতক অভিযুক্ত।
এদিকে, সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ক্ষোভের ঝড়। একের পর এক মানুষ পোস্ট করছেন—“একটা শিশুর প্রাণ গেল, আর দোষী ঘুরে বেড়াচ্ছে—এ কেমন ন্যায়?”
“প্রভাবের জোরে পালাচ্ছে অপরাধী, প্রশাসন কি কেবল দেখেই যাবে?”ধর্মনগরের মানুষ আজ প্রশ্ন করছে—একজন মাতাল চালকের বেপরোয়া আনন্দের জন্য কত মা-বাবাকে এমনভাবে কাঁদতে হবে?পুজোর আলো নিভে গেছে এক ঘরে। মায়ের চোখের জলেই আজ ভিজে আছে সেই আলো।
অভিরূপের নিথর মুখের দিকে তাকিয়ে যেন প্রশ্ন জাগে—“একটু দায়িত্ববোধ থাকলেই কি বাঁচানো যেত না একটা জীবন?”আজ ধর্মনগর কাঁদছে, শুধু একটি শিশুর জন্য নয়, আমাদের উদাসীনতার জন্যও।