
Oplus_131074
প্রতিনিধি অনুপম পাল,কৈলাসহর
৮ই মার্চ—এই তারিখটি কেবল একটি দিন নয়, এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নারীদের আত্মত্যাগ, লড়াই এবং অধিকার আদায়ের সংগ্রামের প্রতীক। ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে নারীর অদম্য সাহস, অসম্ভবকে সম্ভব করার গল্প। সমাজের বাধা, বঞ্চনা, বৈষম্যের কাঁটা পেরিয়ে তারা এগিয়ে গেছে, গড়ে তুলেছে নিজেদের জন্য নতুন এক পৃথিবী।
এই দিনটি স্মরণ করিয়ে দেয় সেই সকল নারীকে, যারা কণ্ঠ রোধের প্রাচীর ভেঙে নিজেদের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। মনে করিয়ে দেয় তাদের, যারা হাজারো প্রতিকূলতার মুখেও স্বপ্ন দেখা থামাননি। নারী শুধু মায়ের প্রতিচ্ছবি নয়, সে সংগ্রামী, সে পথপ্রদর্শক, সে পরিবর্তনের অগ্রদূত।
কৈলাসহর—ত্রিপুরার এক ঐতিহ্যমণ্ডিত জনপদ। এক সময়ের রাজন্য আমলের শহর, যার প্রতিটি অলিগলি, প্রতিটি ঐতিহাসিক স্থাপনা সাক্ষী হয়ে আছে সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশের। তবে এই জনপদের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায় নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রা, তবে তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। এই ইতিহাস কেবল পাঠ্যপুস্তকের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি ত্যাগ, সংকল্প আর আলোর সন্ধানের এক অনবদ্য কাহিনি।
কৈলাসহরের শিক্ষা যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮৭২ সালে “যুবরাজ” স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। কিন্তু তখনও নারী শিক্ষা ছিল এক কল্পনার মতো, সমাজের গণ্ডির বাইরে যাওয়ার এক দুঃসাহসিক প্রয়াস। সেই সময়েও অপ্রথাগতভাবে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা চলত, এক ঘোষ উপাধিধারী মহিলা গোপনে পাঠদান করতেন—যা ছিলো তৎকালীন সময়ে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে এক আশার আলো।
কিন্তু আলো কখনও চিরকাল চাপা থাকে না, ঠিক যেমন সূর্য মেঘ ভেদ করে উদিত হয়। ১৯০৫ থেকে ১৯১৫ সালের মধ্যে মহকুমা শাসকের কার্যালয়ের পাশে, বর্তমানে যেখানে জেলা কর্ম বিনিয়োগ কেন্দ্র রয়েছে এক সময় সেখানেই ছিলো নগর পঞ্চায়েত অফিস, সেখানে ছোট্ট এক চৌচালা ঘরে জন্ম নেয় “মেয়েদের পাঠশালা”—যা ছিলো কৈলাসহরের প্রথম নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
প্রথমদিকে ছাত্রী সংখ্যা নগণ্য হলেও রাজপরিবারের আন্তরিক প্রয়াস এবং বিদ্যানগরের মোহিনী দেবীর নিরলস প্রচেষ্টায় তা ধীরে ধীরে বিস্তার লাভ করে। একসময় এই পাঠশালা পরিণত হয় কৈলাসহর গার্লস প্রাইমারি স্কুলে। এরপর ইন্দ্রময়ী দেবী দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যিনি শিক্ষার্থীদের স্নেহের ‘গুরুমা’ হয়ে ওঠেন। শিক্ষার প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা ও আত্মনিবেদনই নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রাকে দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দেয়।
এরপর কৈলাসহরের বুকে শিক্ষার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয় ১৯৩৫ সালে, যখন মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুর এই শহরে আসেন। কালি দীঘির পারে এক সভায় কৈলাসহর গার্লস স্কুলকে মধ্য ইংরেজি (M.E.) স্কুলে রূপান্তরিত করার দাবি উঠে, এবং মহারাজা তা অনুমোদন করেন। তার ফলে ১৯৩৭ সালে এই স্কুল নতুন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করে—”কৈলাসহর গার্লস এম.ই. স্কুল”।
১৯৫৫ সালে স্কুলটি স্থানান্তরিত হয় বর্তমান স্থানে এবং এটি হয়ে ওঠে “মডেল সিনিয়র বেসিক স্কুল”। যদিও পরবর্তীতে এর নাম হয় কৈলাসহর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়—যা আজও নারী শিক্ষার দীপ্ত এক মশাল হয়ে জ্বলছে।
তৎকালীন সময়ে কৈলাসহরের বিদ্যোৎসাহীরা বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল প্রাথমিক শিক্ষাই যথেষ্ট নয়—নারীদের উচ্চ শিক্ষারও প্রয়োজন। সেই উপলব্ধি থেকেই ১৯৩০-এর দশকের শেষ দিকে প্রহ্লাদ চন্দ্র বর্মন নিজ উদ্যোগে মেয়েদের শিক্ষার প্রসারে ব্রতী হন। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বোঝাতেন, মেয়েদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতেন। শুধু তাই নয়, নিজেই তাদের পাঠদান শুরু করেন।
এরই ফলস্বরূপ, ১৯৩৬ সালে কৈলাসহরের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়—জ্যোতির্ময়ী মজুমদার প্রথম মেট্রিক পাস করেন। এটি ছিল এক বিস্ময়কর ঘটনা, এক বিপ্লব, যা কৈলাসহরের নারী শিক্ষার দরজা খুলে দেয়।
১৯৪৫ সালে উপেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য রাধাকিশোর ইন্সটিটিউশনে প্রাইভেট সেভেন ক্লাস চালু করেন, যেখানে সকালবেলা মেয়েদের জন্য এবং দুপুরে ছেলেদের জন্য পাঠদান হতো। এই নতুন ব্যবস্থার কারণে ১৯৪৯ সালে বৌলাপাশার মঞ্জুলিকা বোস ও পানিচৌকি বাজারের বাসন্তী দাস মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পান। মঞ্জুলিকা বোস পরবর্তীতে ত্রিপুরা মহিলা কমিশনের সভাপতি হন—যা এক অভাবনীয় সাফল্য!
নারী শিক্ষার এই অগ্রযাত্রা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তখন ১৯৫২ সালে ত্রিপুরা সরকারের উদ্যোগে কৈলাসহরে একটি উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিশিষ্ট নাগরিক অখিল চন্দ্র ঘোষের জমিতে এই বিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তদানীন্তন এডভাইজার সুখময় সেনগুপ্ত।
এই স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন প্রতিভা দত্ত। শিক্ষার দীপশিখা জ্বালিয়ে তিনি কৈলাসহরের মেয়েদের এক নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখান। এখানে পড়াশোনা করে বেরিয়ে আসেন ত্রিপুরার প্রথম মহিলা আইএএস কর্মকর্তা শ্যামলিমা দাস, যিনি হয়ে ওঠেন নতুন প্রজন্মের অনুপ্রেরণা।
কৈলাসহরের নারী শিক্ষার ইতিহাস শুধু পরিসংখ্যান নয়, এটি এক গৌরবের আলেখ্য। একদা যেখানে মেয়েদের পড়াশোনা স্বপ্নমাত্র ছিল, সেখানে আজ নারী শিক্ষার সাফল্যের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র ত্রিপুরায়।
কৈলাসহর কেবল একটি শহর নয়, এটি সংস্কৃতি, মনীষা ও শিক্ষার মিলনক্ষেত্র। একদিন যেখানকার সমাজ মেয়েদের শিক্ষার বিরুদ্ধে ছিল, সেখানেই আজ মেয়েরা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসক, গবেষক হয়ে উঠছেন।
নারী শিক্ষা মানে শুধু অক্ষরজ্ঞান নয়, এটি এক মুক্তির আলো। কৈলাসহর সেই আলো বহন করছে যুগ যুগ ধরে—একটি জনপদের, একটি স্বপ্নের, একটি অঙ্গীকারের প্রতীক হয়ে।
“যেখানে জ্ঞানের আলো প্রবাহিত হয়, সেখানে সমাজের বন্ধন খুলে যায়, আর কৈলাসহর সে আলোয় দীপিত—শুধু ত্রিপুরার নয়, সমগ্র দেশের জন্য এক উদাহরণ হয়ে।”