
প্রতিনিধি অনুপম পাল,কৈলাসহর
ভারতবর্ষের ইতিহাসে একদিকে ছিল অত্যাচার, ধর্মান্তরের নিষ্ঠুর রাজনীতি, অন্যদিকে ছিল এক অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধার জন্ম—যিনি শুধু তলোয়ারের ধারেই নয়, নিজের ন্যায়বোধ, স্বরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন এবং জনগণের জন্য অটুট প্রেম দিয়ে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন। একদিকে ছিল মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের অন্ধকারাচ্ছন্ন শাসন, অন্যদিকে ছিলেন ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ, যিনি সেই অন্ধকারের মাঝেও এক দীপ্তমান আলোর শিখা হয়ে উঠেছিলেন।
১৬৫৮ সালে ক্ষমতা দখলের পর, ঔরঙ্গজেব সমস্ত ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নীতি ত্যাগ করে এক কঠোর ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন।
জিজিয়া কর পুনর্বহালের মাধ্যমে(১৬৭৯), অ-মুসলিমদের জন্য বিশেষ কর আরোপ করে তাঁদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হয়। কাশীর কাশী বিশ্বনাথ মন্দির, মথুরার কেশব রায় মন্দিরসহ অসংখ্য হিন্দু মন্দির ভেঙে ফেলা হয়। নবম শিখ গুরু গুরু তেগ বাহাদুর-কে ধর্মান্তর হতে বললে তিনি অস্বীকার করেন, এবং ফলস্বরূপ ১৬৭৫ সালে দিল্লিতে নির্মমভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়। ১৭০৫ সালে দশম শিখ গুরু গুরু গোবিন্দ সিংহের দুই শিশুপুত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
ঔরঙ্গজেবের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম বড় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন মহারাষ্ট্রের বীর শিবাজি মহারাজ। জন্ম থেকেই তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ও সামরিক কৌশলের অধিকারী।১৬৭৪ সালে স্বাধীন হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজেকে “ছত্রপতি” ঘোষণা করেন।কেবল যুদ্ধের ময়দানেই নয়, রাজনৈতিক কূটনীতি, জনসেবার নীতি ও শাসনব্যবস্থা দিয়েও তিনি নিজেকে অনন্য প্রমাণ করেন। তিনি কখনো ধর্মীয় বিভাজন চাননি,বরং তাঁর সেনাবাহিনীতে বহু মুসলিম সৈনিক ছিলেন, এবং তার শাসন কালে তিনি কোনো মসজিদ ধ্বংস করেননি। নারীদের সম্মান রক্ষায় তিনি ছিলেন কঠোর, তাঁর রাজ্যে নারীদের অসম্মান বা নির্যাতন করলে কঠোর শাস্তির বিধান ছিল।
শিবাজি মহারাজ ও ঔরঙ্গজেবের মধ্যে যে লড়াই শুরু হয়েছিল, তা শুধুমাত্র ভূখণ্ড দখলের যুদ্ধ ছিল না—এ ছিল অত্যাচারের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম।
শিবাজির গেরিলা যুদ্ধ কৌশল তাঁর ছোট বাহিনীও মুঘলদের বিশাল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে।১৬৮৯ সালে শিবাজির পুত্র সম্ভাজিকে মুঘলরা নির্মমভাবে হত্যা করে, কিন্তু তাতে মারাঠারা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলোর বিদ্রোহে বিজাপুর ও গোলকোন্ডা দখল করেও সেখানে স্থায়ী শাসন কায়েম করতে পারেননি ঔরঙ্গজেব।
ঔরঙ্গজেবের লাগাতার যুদ্ধ, প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে মুঘল সাম্রাজ্য ধ্বংসের মুখে পড়ে।১৭০৭ সালে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু হয়, এবং তাঁর মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য দ্রুত ক্ষয় হতে থাকে।মারাঠারা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে, এবং পরবর্তী শতকে তারা দিল্লি পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত দখলের সুযোগ পায়, এবং ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটে।
শিবাজির সংগ্রাম ছিল শুধু মুঘলদের বিরুদ্ধে নয়, ছিল এক নৈতিক বিপ্লব। যেখানে রাজনীতির সাথে ধর্মের নাম নিয়ে অত্যাচার চলছিল, সেখানে শিবাজি দেখিয়েছিলেন, প্রকৃত শাসন কেমন হওয়া উচিত।তিনি দেখিয়েছিলেন, একজন শাসকের প্রধান দায়িত্ব তার জনগণকে রক্ষা করা, তাদের সম্মান দেওয়া এবং স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করা।তিনি প্রমাণ করেছিলেন, ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করলে কখনো হার হয় না।
ঐতিহাসিক সত্যকে কখনো মুছে ফেলা যায় না। ঔরঙ্গজেবের কঠোর শাসন ন্যায়, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও মানবিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল, কিন্তু শিবাজি মহারাজের স্বরাজ্যের আদর্শ প্রমাণ করে দিয়েছে—অন্যায় যতই শক্তিশালী হোক না কেন, ন্যায় ও সত্যের বিজয় অবশ্যম্ভাবী।আজকের সমাজেও শিবাজির শিক্ষা প্রাসঙ্গিক। সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত না করা, এবং ধর্মের নামে অত্যাচারের প্রতিবাদ করা—এগুলোই শিবাজির প্রকৃত শিক্ষা। এ কারণেই, আজও উচ্চারিত হয়—“জয় জগদম্বা! জয় ভবানী! হর হর মহাদেব!”