কৈলাসহর,প্রতিনিধি অনুপম পাল,কৈলাসহর শহরের একটি অতি পরিচিত মুখ, রণদা। আসল নাম রঞ্জিত দেব, কিন্তু রণদা বললেই তাঁকে চিনে ফেলেন শহরের সবাই। বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি হলেও তাঁর ক্লান্তিহীন শরীর ও অদম্য মানসিকতা কৈলাসহরের প্রতিটি ভোরকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
একসময় পুর পরিষদ এলাকার কালিপুরে ছিল তাঁর বাসস্থান। তবে প্রকৃতির করুণ পরিহাস, বর্ষার জলে বারবার ভেসে গিয়ে তিনি বাধ্য হন পুর এলাকারই কাজিরগাঁও সংলগ্ন এলাকায় নতুন করে বাসস্থান তৈরির। বিদ্যানগর স্কুলে একসময় পড়াশোনা করলেও দারিদ্র্যের কষাঘাতে সেই শিক্ষা থমকে যায়। আজ দুই ছেলের আলাদা সংসার, আর তাঁর একমাত্র সঙ্গী ছোট্ট এক কুড়ে ঘর এবং স্ত্রী। তিন দশক ধরে সংসার প্রতিপালন করতে রোজ চলে জীবন যুদ্ধের লড়াই।
প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটতেই রণদা শুরু করেন তাঁর লড়াই। এক হাতে গরম চা ভর্তি একটি বড় ফ্লাস্ক, অন্য হাতে একটি বাজারের ব্যাগে আরও একটি ফ্লাস্ক এবং চা তৈরির সরঞ্জাম। কৈলাসহর বাজারের নির্দিষ্ট কিছু জায়গা তাঁর দিনের কর্মক্ষেত্র। শীত, গ্রীষ্ম কিংবা বর্ষা—প্রকৃতির কোনো প্রতিকূলতাই তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারে না।
যাঁরা ভোরবেলা শরীরচর্চা কিংবা হাঁটতে বের হন, তাঁরা জানেন, রণদার সঙ্গে সাক্ষাৎ না হলে সেই সকালটা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাঁর চায়ের কাপের ধোঁয়া, বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি এবং আন্তরিক কথোপকথন—এই সব কিছু মিলিয়ে রণদা কৈলাসহরের ভোরের অপরিহার্য অংশ।
রণদার জীবন ঘড়ির কাঁটার মতো নিয়মিত, বিরামহীন। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত এক অবিচল নিয়মে চলে তাঁর দিন। শহরের কোলাহল কিংবা প্রাত্যহিক জীবনের ব্যস্ততার মধ্যে রণদা যেন এক নীরব যোদ্ধা। তাঁর চা বিক্রির কাজ শুধু তাঁর রুটি-রুজির ব্যবস্থা নয়, এটি শহরের সঙ্গে তাঁর একটি আত্মিক সংযোগ।
শহরের মানুষদের কাছে রণদা শুধু একজন চা বিক্রেতা নন,তিনি ভোরের প্রতীক, জীবনের নিরন্তর সংগ্রামের অনুপ্রেরণা। প্রতিদিনের চায়ের কাপের সঙ্গে যেন তিনি পরম মমতায় বিলিয়ে দেন নিজের শ্রম, ভালোবাসা এবং মানবিকতার উষ্ণতা।
রণদা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে জীবন আসলে একটি নিরন্তর সংগ্রাম। প্রতিটি ভোর নতুন করে বাঁচার সুযোগ দেয়, নতুন স্বপ্ন বুনতে শেখায়। কৈলাসহরের এই অতি সাধারণ মানুষটির গল্পে আমরা জীবনের এক অসাধারণ দিক খুঁজে পাই—প্রত্যাশা, পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়।
তাঁর হাতের এক কাপ চা শুধু শরীর নয়, মনকেও উষ্ণ করে। রণদার গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে ছোট ছোট সংগ্রামে, যা আমাদের মানবিকতাকে স্পর্শ করে যায়।