প্রতিনিধি অনুপম পাল, কৈলাসহর
কৈলাসহরের রাজনীতি যেন আবারও আগুনে পেট্রোল ঢালল। বিদেশি অনুপ্রবেশ ইস্যু ঘিরে তীব্র রাজনৈতিক সংঘর্ষে মুখোমুখি শাসক ও বিরোধী শিবির। একদিকে কংগ্রেস বিধায়ক বীরজিৎ সিনহার বিস্ফোরক অভিযোগ, অন্যদিকে শাসক দলের মন্ত্রী টিংকু রায়ের পাল্টা আক্রমণ—সব মিলিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে কৈলাসহরের রাজনৈতিক আবহাওয়া।
সম্প্রতি জেলা কংগ্রেস ভবনে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে বিধায়ক বীরজিৎ সিনহা সোজাসুজি অভিযোগ তুললেন—“শাসক দলের সরাসরি সহযোগিতায় বিদেশি অনুপ্রবেশ ঘটছে।” তাঁর দাবি, বাংলাদেশের সিলেট জেলার সঞ্জয় চক্রবর্তী নামের এক ব্যক্তি বর্তমানে ত্রিপুরার ঊনকোটি জেলার চণ্ডীপুর বিধানসভার শ্রীরামপুর গ্রামে দীপক চক্রবর্তী নামে বসবাস করছে।বিধায়কের বক্তব্য অনুযায়ী, “সঞ্জয় চক্রবর্তীর বাংলাদেশের আইডি কার্ড রয়েছে, এমনকি বাংলাদেশের একটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার সদস্য হিসেবেও সে কাজ করে। তার নামে বাংলাদেশের ব্যাংক অ্যাকাউন্টও সক্রিয়। অথচ ভারতে এসে সে নাম পরিবর্তন করে দীপক চক্রবর্তী নামে আধার কার্ড ও আর ও আর তৈরি করেছে।তার অভিযোগ,সেই বাংলাদেশি যুবক বর্তমানে চণ্ডীপুর বিধানসভার মন্ত্রী টিংকু রায়ের বাড়ির পাশেই থাকছে। দুর্গাপূজার সময় সেই বাংলাদেশি ব্যক্তি মন্ত্রীর বাড়িতে রান্নার দায়িত্বে ছিল। এই ঘটনাই প্রমাণ করে শাসক দলের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে অনুপ্রবেশ ঘটছে।”
বীরজিৎ সিনহা তথ্যসহ অভিযোগ তুলে ধরে বলেন, “শ্রীরামপুর পঞ্চায়েত কীভাবে একজন বাংলাদেশীকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আর ও আর ইস্যু করল? পিতার নামও পরিবর্তন করে দিয়েছে—বাংলাদেশের সুরথ চক্রবর্তীর ছেলে এখন হয়ে গেছে দিলীপ চক্রবর্তী!”
দেশের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিধায়ক কটাক্ষ করেন, “শাসক দলের ছত্রছায়া ছাড়া এসব সম্ভব নয়। এই অবৈধ অনুপ্রবেশ বন্ধ করা দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে জরুরি। কংগ্রেস এই ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রী ও পুলিশের মহা-নির্দেশকের নিকট লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। পাশাপাশি চণ্ডীপুরের প্রতিবাদী সংগঠনের পক্ষ থেকেও মন্ত্রীর বিরুদ্ধে থানায় মামলা করার প্রস্তুতি চলছে।
বিরোধী অভিযোগের পাল্টা দিতে কোনো আনুষ্ঠানিক সাংবাদিক সম্মেলন না করলেও, দলীয় এক কর্মসূচিতে মঞ্চ থেকে মন্ত্রী টিংকু রায় সরাসরি জবাব দেন বীরজিৎ সিনহাকে।
তিনি বলেন, “বিরজীৎ সিনহা আমার থেকে বয়সে বড়, সত্তরোর্ধ্ব একজন বিধায়ক দুদিন অন্তর সাংবাদিক সম্মেলন করে নানা অভিযোগ করেন। আমি কোনোদিনও এসব কথার উত্তর দিতে চাইনি, কারণ আমি জানি মিথ্যার মুখোশ বেশীদিন টেকে না। তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বলেন,আপনারা সকলেই আমার বাড়িতে যান। যেখানে একটি ঘরে আমি থাকি এবং একটি হলঘরে আমি প্রতিনিয়ত মানুষের সাথে দেখা করি যেখানে আপনারাও আসেন। আমার বাড়ির গেইট সবসময় সকলের জন্য উন্মুক্ত। যে কেউ আসতে পারেন। উনি বলছেন আমি নাকি বাংলাদেশি কাউকে ভাড়া দিয়েছি! যাকে নিয়ে এত কথা, সেই ছেলেটা এখানকারই — এই এলাকায় জন্ম, এখানেই বড় হয়েছে। তার বাবাও এখানকার মানুষ। আমি তার পরিবারের নামও জানি— প্রল্লাদ, যে আমার বাড়িতে রান্না করে, সে ছোটবেলা থেকে এই এলাকাতেই আছে।যখন বীরজিৎ সিনহার মা এই কৈলাসহরে মুড়ি বিক্রি করতেন, তখন থেকেই যাদের নামে উনি আজ অপবাদ দিচ্ছেন, তারা সেই মুড়ি কিনতেন এবং উনার মাকেও জানতেন। এমন মানুষদের আজ তিনি বাংলাদেশি বানাচ্ছেন! মন্ত্রী টিংকু রায় বলেন,যাদের কোনো নীতি নেই, নৈতিকতা নেই, তারাই আজ মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে। যারা কৈলাসহরের রাজপথকে রক্তে রাঙিয়েছে, সেই সিপিআই(এম)-এর হাত ধরে আজ কংগ্রেস রাজনীতি করছে। এই হল তাদের আদর্শ।”
যেখানে দেশের সরকার বলেছে, ২০২৫ পর্যন্ত যেসব হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশী উদ্বাস্তু ভারতে এসেছে, তারা আশ্রয় পাবে। কিন্তু আমি সেদিকে যাচ্ছি না। আমি শুধু বলছি—যাদের নাম নিয়ে মিথ্যা ছড়ানো হচ্ছে, তারা এখানকারই স্থানীয় বাসিন্দা।
একদিকে বীরজিৎ সিনহার “বিদেশি অনুপ্রবেশ” ইস্যু তুলে ধরা কংগ্রেস, অন্যদিকে টিংকু রায়ের “মিথ্যাচার ও নীতিহীনতার” পাল্টা আক্রমণ—সব মিলিয়ে কৈলাসহরের রাজনীতি এখন উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরি।জনগণ এখন অপেক্ষায়, প্রশাসন এই অভিযোগ-প্রত্যঅভিযোগের জটিল সমীকরণের মধ্যে কতটা সত্যতা খুঁজে পায়। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—কৈলাসহরে উন্নয়ন নয়, এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ‘বিদেশি অনুপ্রবেশ’। আর সেই বিতর্ক ঘিরে যেন শুরু হয়েছে এক নতুন রাজনৈতিক নাটক—যার মঞ্চ কৈলাসহর, চরিত্রে দুই প্রভাবশালী নেতা—বীরজিৎ সিনহা ও টিংকু রায়।