
প্রতিনিধি অনুপম পাল,কৈলাসহর
বাঙালির হৃদয়ে যে উৎসব সবচেয়ে বেশি আবেগ, আনন্দ, মিলন ও ভালবাসার আবহ নিয়ে আসে, তা হলো দুর্গাপূজা। শুধু পূজা নয়, এ যেন এক অদৃশ্য বাঁধন, যা বাঙালিকে একসূত্রে গেঁথে রাখে। প্রতিটি বাঙালির মনে পূজার দিনগুলো মানেই নতুন জামার গন্ধ, আলপনায় আঁকা উষ্ণতা, ধুনো-ধূপের গন্ধে ভেসে যাওয়া সকালের অঞ্জলি, ঢাকের বাদ্যের ছন্দে ভোর থেকে রাত পর্যন্ত আনন্দে মেতে ওঠা।কিন্তু যত আনন্দ, উল্লাস, হাসি আর মিলনের রঙে ভরে ওঠে এই কয়েকটা দিন, ততই এক দিক থেকে থেকে যায় এক অদ্ভুত ব্যথা। বিজয়ার ঢাক বাজতে না বাজতেই বুকের ভেতর কেমন শূন্যতা তৈরি হয়। বিসর্জনের সময় নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে যখন দেখা যায় মা ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছেন, তখন বুক ভিজে ওঠে অজস্র বাঙালির চোখের জলেই। এ যেন উৎসবের শেষে এক অব্যক্ত হাহাকার।এই হাহাকারই আমাদের অপেক্ষার নাম। আরো এক বছর অপেক্ষা করতে হবে মায়ের আগমনের জন্য। আবার শারদীয়ার সেই সকালের ধূপকাঠির গন্ধে ভেসে ওঠা, আবার মণ্ডপে মণ্ডপে ভিড় জমা, আবার অঞ্জলির ফুল হাতে প্রার্থনা, আবার ঢাকের তালে নাচা—সবকিছুই যেন এক প্রতিশ্রুতির মতো।বাঙালির কাছে দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি সংস্কৃতির, আবেগের, পারিবারিক মিলনের, আর মনের গভীরতম আনন্দের প্রতীক। তাই মায়ের বিদায় মানেই অগণিত মানুষের চোখে জল, আবার সেই জলেই মিশে থাকে আগামী বছরের আনন্দের প্রতীক্ষা।
তবে এই বছরের পূজায় আনন্দের পাশাপাশি শাস্ত্রীয় দৃষ্টিতে এক বিশেষ আলোচনাও উঠে এসেছে। শাস্ত্রমতে, দেবীর আগমন ও গমন ভঙ্গি সমাজ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ইঙ্গিত বহন করে।এই বছর দেবীর আগমন হয়েছে গজে (হাতি বাহনে)।হাতি বাহনে আগমনকে অত্যন্ত শুভ হিসেবে মানা হয়। বিশ্বাস করা হয়, মায়ের গজে আগমন মানেই সমৃদ্ধি,শান্তি ও শুভ সময়ের বার্তা। সমাজে শান্তির আবহ বিরাজ করবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অনটন অনেকটাই দূরে থাকবে। কৃষিজীবী মানুষের ক্ষেতেও এটি আশার আলো বয়ে আনে, কারণ হাতি সমৃদ্ধি ও ভাণ্ডারের প্রতীক।
কিন্তু দেবীর গমন হয়েছে দোলায় (দোলনায়)।শাস্ত্রমতে দোলায় গমন শুভ নয়। এর সঙ্গে জড়িত আছে আশঙ্কার বার্তা। প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী, দেবীর দোলায় বিদায় সমাজে অস্থিরতা, মহামারী, অর্থনৈতিক সংকট বা সামাজিক অশান্তি ডেকে আনতে পারে। মানুষকে সতর্ক থাকতে হবে, আর্থিক মন্দা ও স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার বিরুদ্ধে প্রস্তুত থাকতে হবে।ফলে, এবারের পূজা বাঙালির মনে যেমন নতুন আশার আলো জাগিয়েছে, তেমনই রেখে গেছে এক ধরনের উদ্বেগ। একদিকে মায়ের হাতি বাহনে আগমন আমাদের মনে আশা জাগায় যে আগামী দিনগুলো হবে সমৃদ্ধি ও শান্তিতে ভরা। অন্যদিকে, দোলায় বিদায়ের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছে সামনে কিছু চ্যালেঞ্জ আসতে পারে।তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—বাঙালি সব প্রতিকূলতার মধ্যেও এগিয়ে চলেছে। মা দুর্গার বিদায় শুধু ব্যথার বার্তা নয়, বরং নতুন প্রতীক্ষার সূচনা। এই প্রতীক্ষার ভেতর দিয়েই আবার শুরু হলো কাউন্টডাউন—কবে আসবে মহালয়া, কবে ভেসে উঠবে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে সেই মহিষাসুরমর্দিনীর গান।
শূন্যতার ভেতর দিয়েই শুরু হয় নতুন করে প্রতীক্ষার দিনপঞ্জি। প্রতিদিনের ব্যস্ততার মাঝেও মনে মনে ক্যালেন্ডার গুনতে থাকে বাঙালি—কবে আসবে মহালয়া, কবে বাজবে আবার সেই দূর্গতিনাশিনী মায়ের আগমনী বার্তা।মা দুর্গার বিদায় যেন আসলে আগামী বছরের নতুন আশার, নতুন আনন্দের আহ্বান। তাই তো বাঙালি বুক ভরে বলে—”আসছে বছর আবার হবে।”