
সংবাদ প্রতিনিধি। অনুপম পাল
মুম্বইয়ের আকাশ আজ ভারী। বাড়ির উঠোনে পৌঁছেছে এক তাজা মৃতদেহ—সায়নীতা চক্রবর্তী, বয়স মাত্র ৩৫। বিমানসেবিকা, পেশায় আকাশযাত্রীদের সুরক্ষার সাথী, অথচ নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। ১২ জুন আহমেদাবাদে ঘটে যাওয়া সেই ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার এক নীরব সাক্ষী হয়ে ফিরলেন তিনি—নিঃসাড়, নিথর।
প্রয়াত সায়নীতা চক্রবর্তী ছিলেন মুম্বইয়ের মেয়ে। গো এয়ার-এ বহু বছর কাজ করার পর সম্প্রতি তিনি যোগ দিয়েছিলেন এয়ার ইন্ডিয়াতে। এই নবযাত্রায় ছিল আশার আলো, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা, নিজের জন্য, পরিবারের জন্য এক গর্বিত অধ্যায় রচনা করার স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্ন থেমে গেল এক বিকেলের আকাশে, যখন অভিশপ্ত এআই-১৭১ বিমানটি উড়ানের কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেঙে পড়ে আহমেদাবাদের মেঘানীনগর এলাকায় একটি মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের উপর।
ঘটনাটি ঘটেছিল দুপুরবেলায়, যখন হোস্টেলের ক্যান্টিনে ছাত্ররা খাচ্ছিলেন মধ্যাহ্নভোজ। কেউ ভাবতেও পারেনি, এই পবিত্র শিক্ষাঙ্গনে ঝরে যাবে এতগুলি প্রাণ। দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৭০ জন। এই করুণ পরিণতি যেন গোটা জাতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।
বিমানটির ১০ জন কেবিন ক্রু-র মধ্যে ছিলেন সায়নীতা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাত্রীদের সেবা করা ছিল তাঁর প্রতিদিনের কাজ। অথচ নিজের শেষ যাত্রায় তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অসহায়। অগ্নিগর্ভ আকাশে যখন বিমানটি ছুটছিল অজানা পরিণতির দিকে, সায়নীতা হয়তো সেই মুহূর্তেও যাত্রীদের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন সাহায্যের হাত বাড়াতে।
মুম্বইয়ে তাঁর মরদেহ পৌঁছতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর মা, বাবা, এবং ছোট ভাই। পাড়া প্রতিবেশীরাও স্তব্ধ, যাঁরা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না যে হাসিমুখে বিমানবন্দরে যাওয়া সেই মেয়েটি আর ফিরবে না।
এই দুর্ঘটনা শুধু একটি পরিবারের স্বপ্নভঙ্গ নয়, এটি গোটা দেশের বিমান নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর এক বড় প্রশ্নচিহ্ন। কেন এমন হল? কীভাবে একটি অভিজ্ঞ বিমানচালিত সংস্থা, শতাধিক যাত্রী নিয়ে উড়ে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ হারালো? তদন্ত চলছে, কিন্তু উত্তর এখনো অজানা।
তবে একটি উত্তর স্পষ্ট—সায়নীদের হারানো যায়, ভুলে যাওয়া যায় না। তাঁর কর্মনিষ্ঠা, তাঁর স্বপ্ন, তাঁর জীবনের প্রতি ভালোবাসা, আমাদের মনে রেখে দেবে এই সত্য যে, আকাশ শুধু উঁচুতে উড়বার স্থান নয়, আকাশ কখনো কখনো কান্না চেপে রাখা মায়ের বুকের মতোও।
আজ মুম্বইয়ের মাটিতে সায়নিতা ফিরে এলেন। তবে এই ফিরে আসা নয় আশার, নয় পুনর্মিলনের—এ এক বিদায়ের ফিরে আসা। তাঁর নিঃশব্দ কফিনে লেপ্টে আছে বহু না বলা কথা, অগণিত না দেখা স্বপ্ন।