
প্রতিনিধি অনুপম পাল,কৈলাসহর
“হামদের বাগানে তোদের ফুটানি নাই চলবেক।”এই একটিমাত্র সংলাপেই ফুটে উঠছে উত্তর ত্রিপুরার চা-বাগান এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি ও চাপা ক্ষোভ। কালিশাসন চা বাগানে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি মর্মান্তিক ঘটনার পর, গোটা সমাজ প্রশ্ন তুলেছে—এই কি আমাদের ‘সভ্য’ সমাজ? নাকি গণতন্ত্রের মুখোশ পরে চলছে এক ন্যক্কারজনক অমানবিক বিচারব্যবস্থা?
মঙ্গলবার দুপুরে কালিশাসন চা বাগানের পাশে একটি গাড়ি দুর্ঘটনার ঘটনায় চা-শ্রমিক আহত হন। এরপর ঘটনাস্থলে উপস্থিত উত্তেজিত জনতা চালক প্রদীপ দাসকে ধরে ফেলে ও বাগানের ভিতরে নিয়ে গিয়ে রীতিমতো মব লিঞ্চিং করে হত্যা করে। অজ্ঞাত পরিচয় কিছু লোকের হাতে প্রকাশ্য দিবালোকে একটি তরতাজা প্রাণ চলে গেল—আইনের শাসনের কোন চিহ্নই রইল না সেখানে।
হত্যাকাণ্ডের পরে অন্তত ১৩ জন চা-শ্রমিককে (পুরুষ ৫, মহিলা ৮) রাতভর থানায় বসিয়ে রাখা হয়েছে। কারোর বিরুদ্ধে এখনও কোনো প্রামাণ্য তথ্য নেই, কেউই অভিযুক্ত নন। অথচ তাঁদের সঙ্গে অপরাধীর মতো আচরণ করা হচ্ছে। পেটের দায়ে যারা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে সংসার চালায়, সেই গরিব শ্রমিকদের উপরেই এই রাষ্ট্রীয় শোষণ?
পুলিশ বলছে, “তদন্তের স্বার্থে জেরা করা হচ্ছে।” কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—তদন্ত কি শুধুই গরিবদের গায়ে হাত রেখে হয়? অপরাধীর খোঁজে গোটা শ্রমিক সমাজকে কলঙ্কিত করা কোন নীতির অধীনে পড়ে?
এক শ্রমিক নেতার কথায়—“আমরা কখনো অন্যায়কে সমর্থন করি না। দোষীদের খুঁজে বার করুক পুলিশ, শাস্তি দিক। কিন্তু তার মানে কি গোটা বাগানকে থানায় বসিয়ে অপমান করতে হবে? নিরপরাধ মানুষদের রাতভর না খাইয়ে বসিয়ে রাখা কি মানবিক?”
এই ঘটনায় শ্রমিক মহলে একপ্রকার বিদ্রোহের সুর শোনা যাচ্ছে। হুঁশিয়ারি দিয়ে বাগান শ্রমিকদের একাংশ বলেছে—আজ রাতের মধ্যে নির্দোষদের না ছাড়া হলে, কাল থানা ঘেরাও হবে। তীব্র প্রতিবাদ গড়ে উঠবে বাকি বাগানগুলোতেও।
যে ভয়াবহ গণপিটুনির ঘটনা সামনে এসেছে, তাতে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে। মব লিঞ্চিংয়ের ঘটনা বরাবরই এক অন্ধ উন্মাদনার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু সেই উন্মাদনার বিরুদ্ধে প্রশাসনের দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠা, নিরপেক্ষ তদন্ত এবং নিরীহদের সুরক্ষা।
তবে এখন যা চলছে তা যেন এক ‘দোষী ধরতে গিয়ে নিরপরাধ পিষে দেওয়া’র অভিযান। এভাবে চলতে থাকলে সমাজে বিশ্বাস ও ন্যায়ের উপর থেকে সাধারণ মানুষের আস্থা উঠে যাবে। তখন শুধু আইন নয়, পুরো ব্যবস্থাই প্রশ্নের মুখে দাঁড়াবে।এই ঘটনার পর প্রমাণ করে দিয়েছে—রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা আর পুলিশের আচরণ আজও বহু জায়গায় শ্রেণি ও অবস্থানভেদে বিভক্ত। এই বিভাজন ভাঙতে হলে, এই মুহূর্তে প্রয়োজন উদাহরণমূলক বিচার। দোষীদের দ্রুত গ্রেফতার ও কঠোর শাস্তি দিতে হবে। এবং একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে—একজন নিরপরাধও যেন আর হয়রানির শিকার না হন।সুত্রের খবর,যাদের থানায় বসিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের অধিকাংশই দুর্ঘটনার সময় বাগানের ভেতরে ছিলেনই না। তাহলে কিসের ভিত্তিতে এই তদন্ত? কার ইশারায় এই দমননীতি?
শ্রমিকদের একটাই কথা,”দোষী দের ধরে তোরা শাস্তি দে, হামাদের কোনো অসুবিধা নাই, কিন্তু জোর জবরদস্তি করে হামাদের ফাঁসাতে চাইলে, আমরাও চুপ থাইকবনা। আমরা শ্রমিক “হামদের বাগানে তোদের ফুটানি নাই চলবেক।”