
Oplus_131074
প্রতিনিধি অনুপম পাল
কৈলাসহর,ঊনকোটি, ত্রিপুরা
“আমি নারী, আমি জননী,
লড়াই আমার রক্তে মাখা,
আকাশ ছুঁবো, পাহাড় ঠেলবো,
আমার বুকেই বজ্র আঁকা।”
কৈলাসহরের ব্যস্ত মাছ বাজারের এক কোনে, সকালের কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্যের আলো যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন রাস্তার ধারে বসে থাকা এক নারীর মুখেও ঝিলিক দেয় আলো। হাতে মাছ কাটার ছুরি, পাশে ছোট্ট একটি ঝুড়ি, আর সামনে জীবন যুদ্ধের অন্তহীন অধ্যায়। তার ক্লান্ত চোখে লেগে আছে সংগ্রামের ছাপ, কিন্তু সেই চোখের গভীরে জ্বলছে এক অদম্য আগুন। তিনি চম্পা দাস (৪০), চন্ডীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের ৫নং ওয়ার্ডের এক দুর্দমনীয় নারী, যিনি প্রতিদিন জীবনযুদ্ধে নতুন করে জয়ী হওয়ার চেষ্টা করছেন।
একসময় স্বামী দীপু দাস ছিলেন তার পৃথিবীর একমাত্র ভরসা। কৈলাসহরের মাছ বাজারের প্রবেশদ্বারে ছোট্ট একটি দোকান ছিল তার। প্রতিদিন সকালে মাছের ঝুড়ি কাঁধে বাজারে যেতেন, আর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেন সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন নিয়ে। ছেলে দীপক দাস (১৭) ও মেয়ে পল্লবী দাস (২১)—তাদের ছোট ছোট চাওয়া, স্কুলের ফি, কলেজের খরচ—সবকিছুই তার হাত ধরেই চলত। কিন্তু বিধাতা যখন লিখেছেন এক নারীর সংগ্রামের ইতিহাস, তখন কি এত সহজেই থেমে যেতে দেন?
এক রাতে ২০১৮ সালে ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হলেন দীপু দাস। হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই নিভে গেল তার জীবন প্রদীপ। শুধু স্বামীই নয়, চম্পা সেদিন হারালেন তার সংসারের চালিকাশক্তি, সন্তানের নিরাপত্তার আশ্রয়।
স্বামী চলে যাওয়ার পর কেউ কিছুদিন সহানুভূতি দেখিয়েছেন। কিন্তু সমাজের করুণা দিয়ে তো আর সংসার চলে না! অভাব যখন চারপাশ থেকে চেপে ধরল, তখন চম্পা একটুও দমে যাননি। তিনি স্বামীর পেশাককেই নিজের অস্ত্র বানালেন—কৈলাসহরের মাছ বাজারে স্বামীর জায়গাতেই বসতে শুরু করলেন।
সারা বাজারে তিনিই একমাত্র মহিলা—যিনি পুরুষদের ভিড়ে মাথা উঁচু করে মাছ বিক্রি করেন, মাছ কাটেন, আর নিজের ভাগ্যকে প্রতিদিন নতুন করে গড়ে নেন।
ভোরবেলা মাছের আড়তে ছোটেন, নিজের সাধ্যমতো কিছু মাছ কিনে নিয়ে আসেন। রাস্তার ধারে ডালার মধ্যে মাছ সাজিয়ে বসেন। কেউ মাছ কিনে নেন, কেউ মাছ কাটাতে দেন। চোখে ঘুম নেই, শরীরে ক্লান্তি নেই—মেয়ে পল্লবীর স্বপ্ন যেন তার প্রতিটি রক্তবিন্দুতে মিশে গেছে।
মেয়ে পল্লবীর জন্য তার স্বপ্ন ছিল বিশাল। শত কষ্টের মধ্যে মেয়েকে কলেজ পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তৃতীয় বর্ষে এসে সেই স্বপ্ন থমকে গেছে। সংসারের খরচ চালাতে গিয়ে মেয়ের পড়াশোনা আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। একদিন যাকে তিনি সমাজের উচ্চস্থানে দেখতে চেয়েছিলেন, সে কি তাহলে এই অভাবের ফাঁদেই আটকে থাকবে?
সরকারের দেওয়া আয়ুষ্মান কার্ড তার নিজের চিকিৎসার নিশ্চয়তা দেয়, বিধবা ভাতা কিছুটা স্বস্তি আনে, কিন্তু সংসার চলে না। বিপিএল কার্ড নেই, নেই প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার অধীনে একটি সরকারি ঘর।
এখনো মামা শ্বশুরের দেওয়া সামান্য জমিতে কুঁড়ে ঘরেই দিন কাটছে মা-ছেলে-মেয়ের। বাড়ির পথও পাকা হয়নি, বাঁশের সাঁকো দিয়ে প্রতিদিন ঘরে পৌঁছাতে হয়। সেই সাঁকো পার হতে গিয়ে প্রতিদিন মনে হয়—এ এক যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে তার অস্ত্র শুধু একজোড়া ক্লান্ত হাত আর এক অদম্য মনের জেদ!
এই লড়াই শুধু চম্পা দাসের একার নয়, এ লড়াই সমস্ত সংগ্রামী মায়েদের, যারা প্রতিদিন নিজের সবটা দিয়ে সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চান। সমাজের লোকেরা নানা কথা বলে, অনেকেই করুণা দেখায়, কিন্তু চম্পা কারও করুণা চান না—তিনি চান তার মেয়ের পড়াশোনা শেষ হোক, তার নিজের ঘর হোক, তার সন্তানরা যেন মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে।
আমরা সংবাদকর্মীরা সরকারের প্রতিনিধি নই, তবুও প্রতিশ্রুতি দিলাম—চম্পা দাসের এই লড়াইয়ের কথা তুলে ধরব। যাতে প্রশাসনের কানে পৌঁছায়, যাতে সরকার সত্যিই ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগানকে বাস্তবে রূপ দেয়।
হয়তো একদিন পল্লবী সত্যিই সমাজের রোল মডেল হবে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। কিন্তু চম্পা দাস? তিনি তো আজই একজন রোল মডেল! তিনি এক সাহসিনী, এক লড়াকু মা, এক জীবন্ত অনুপ্রেরণা।
“আমি নারী, আমি জননী,
প্রতিদিন গড়ি এক নতুন ইতিহাস,
সংগ্রাম আমার পরিচয়,
আমার রক্তেই লেখা হোক জয়।”