
Oplus_131072
প্রতিনিধি অনুপম পাল
কৈলাসহর,ঊনকোটি ত্রিপুরা
জীবন কতটা ক্ষণস্থায়ী, তা আমরা বেশিরভাগ সময় ভুলে থাকি। আমরা ধরে নিই, আমাদের হাতে অগণিত দিন পড়ে রয়েছে, আরও অনেক কিছু করবার আছে, আরও অনেক স্বপ্ন দেখার আছে। অথচ, বাস্তবতার নির্মম সত্য ঠিক অন্য কথা বলে—এখানে কেউ চিরস্থায়ী নয়। এই অমোঘ সত্যের সান্নিধ্যে যেতে হলে, একবার ঘুরে আসুন শ্মশানঘাটে।
সেখানে গেলে উপলব্ধি হবে, যার ছিল অগাধ ঐশ্বর্য, যার ছিল অসীম ক্ষমতা, যার ছিল সুখের রাজপ্রাসাদ—শেষ পর্যন্ত তাকেও এই চিতার আগুনে বিলীন হতে হয়েছে।
শ্মশানে গেলে দেখবেন, সেখানে কোনো কোলাহল নেই, নেই কোনো প্রতিযোগিতা, নেই বৈষম্য। ধনীর চিতা যেমন জ্বলে, তেমনই জ্বলে দরিদ্রের চিতা। এই আগুন কাউকে ছাড় দেয় না, কাউকে বিশেষ সম্মানও দেয় না। সমস্ত পরিচয়, সমস্ত গৌরব, সমস্ত অহংকার মুহূর্তেই মিলিয়ে যায় ধোঁয়ায়।
চিতার লেলিহান শিখা যেন বলে ওঠে, “শেষে এসে আমরা সবাই সমান। যাকে তুমি শ্রদ্ধা করেছিলে, যে ছিল তোমার অহংকার, সে-ও এখন একমুঠো ছাই হয়ে গেছে।” শ্মশানে দাঁড়িয়ে থাকলে বুঝতে পারবেন, মৃত্যু কতটা নিরপেক্ষ, কতটা অবিচল।
কেউ যদি জীবনের প্রকৃত উপলব্ধি চান, তবে উচ্ছ্বাসময় মেলার বদলে একদিন শ্মশানঘাটে গিয়ে দাঁড়ান। সেখানে গিয়ে দেখবেন, মানুষের জীবন কতটা অস্থায়ী, কতটা ক্ষণস্থায়ী! চোখের সামনে চিতা জ্বলতে দেখলে বোঝা যায়, আমরা যা কিছু নিয়ে অহংকার করি—তা এক মুহূর্তেই নিঃশেষ হয়ে যায়।
শ্মশান আপনাকে এক নির্মম সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবে। বলবে, “তুমি যা করছো, যত কিছু জমিয়ে রাখছো, তার কিছুই সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না। শুধু ভালো কাজের স্মৃতি, মানুষের মনে তোমার ভালোবাসার ছাপটুকুই থেকে যাবে।”
বিলাসিতার শহর, আলোকিত রাস্তা, ব্যস্ত বাজার—এসবের মাঝে আমরা কখনোই জীবনকে গভীরভাবে বুঝতে পারি না। কিন্তু শ্মশান তার গভীর শূন্যতা দিয়ে আমাদের শেখায় বিনয়, সংযম আর জীবনের প্রকৃত অর্থ।
অনেকেই বলেন, শ্মশানভূমি নাকি ভয়ঙ্কর। কিন্তু আসলে শ্মশানই সবচেয়ে শান্ত জায়গা। এখানে কেউ কারও বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় নামে না, কেউ কাউকে কষ্ট দেয় না, কেউ অন্যের ক্ষতি করতে চায় না। এখানে শুধুই নিরবতা, শুধুই উপলব্ধি।
শেষ পর্যন্ত এই চিতাই আমাদের চূড়ান্ত পরিণতি। যত নাম, খ্যাতি, বিত্ত-বৈভবই থাকুক না কেন, একদিন আমাদের সবাইকে এই একই পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে হবে। শ্মশানে গেলে মনে হবে—যে জীবনের জন্য এত লড়াই, এত হিংসা-বিদ্বেষ, এত আকাঙ্ক্ষা, তার শেষ তো একমুঠো ছাই!
তাহলে কেন এত অহংকার? কেন এত বিদ্বেষ? কেন এত হানাহানি? যদি একদিন এই চিতার আগুনেই সব শেষ হয়ে যায়, তবে কেন ভালোবাসার আলোয় জীবনকে আলোকিত করে তোলা যাবে না?
একদিন আমরাও কেউ না কেউ, কোথাও না কোথাও এক চিতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকব, হয়তো কেউ আমাদের চিতার সামনেও দাঁড়াবে। তাই শ্মশান আমাদের শেখায়, অহংকার নয়, ক্ষমা করো; হিংসা নয়, ভালোবাসো; লোভ নয়, সংযম শেখো।
কারণ, শেষে সবাইকেই এক সমাপ্তির পথে যেতেই হবে—সেখানে কেউ ভিআইপি নয়, কেউ ভিখারিও নয়।