
প্রতিনিধি অনুপম পাল,কৈলাসহর
সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ—বরফে ঢাকা উপত্যকায় শান্তির আবহ হঠাৎ ভেঙে যায় দাবির আগুনে। তাপমাত্রা মাইনাসে নেমে গেলেও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে হিমালয়ের বুক। লাদাখ জুড়ে প্রতিবাদ, স্লোগান, গণসমাবেশ। তাদের দাবিগুলি স্পষ্ট ও দৃঢ়—১)লাদাখকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া,২)ষষ্ঠ তপশিলের অন্তর্ভুক্তি,৩)স্বতন্ত্র পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন, এবং ৪) লোকসভা আসন সংখ্যা ১ থেকে বাড়িয়ে ২ করা।২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার পর, অঞ্চলটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ হয়—জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ।সেই সময় কাশ্মীরে তীব্র প্রতিবাদ হলেও, লাদাখের মানুষ উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, এই পরিবর্তনে উন্নয়ন ও সুযোগের নতুন দিগন্ত খুলবে। কিন্তু পাঁচ বছর কেটে গেলেও কেন্দ্রের প্রতিশ্রুতি বাস্তবের মুখ দেখেনি।পরিবেশ বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবক সোনম ওয়াংচুক, যিনি গান্ধীবাদী চেতনায় বিশ্বাসী, বারবার লং মার্চ, অনশন, সভা ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে কেন্দ্রকে প্রতিশ্রুতি রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। এবারও সেই ধারাবাহিকতায় তিনি লাগাতার অনশনে বসেন, যার জেরে দু’জন আন্দোলনকারী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তাতেই উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে লাদাখ জুড়ে—শীতার্ত উপত্যকা জ্বলে ওঠে মানুষের দাবিতে।
লাদাখ মানেই প্রকৃতির গবেষণাগার।একদিকে চিন সীমান্ত, অন্যদিকে পাকিস্তান —ভূরাজনৈতিকভাবে অতি সংবেদনশীল অঞ্চল। এখানকার বরফে মোড়া পর্বত, গলিত হিমবাহ, ও বিরল খনিজ সম্পদ দেশ ও বিশ্বের নজরে।
জলবায়ু পরিবর্তনে ক্রমে গলে যাচ্ছে বরফ, শুকিয়ে যাচ্ছে নদী। ফলে কৃষি, পানীয় জল, এমনকি মানুষের দৈনন্দিন জীবন বিপর্যস্ত।
এই প্রেক্ষিতে সোনম ওয়াংচুক তৈরি করেছেন এক অভিনব উদ্ভাবন—কৃত্রিম হিমবাহ (Artificial Glacier)। পাইপের মাধ্যমে নদীর জল পাহাড়ের উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে হিমবাহের মতো বরফ তৈরি করেন তিনি,যা গ্রীষ্মকালে গলে সেচ ও পানীয় জলের চাহিদা মেটায়। এই প্রযুক্তি এখন বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত।
হিমালয়ের পর্বতমালা এখন বিপর্যয়ের মুখে। অরণ্যবিনাশ, পর্যটনের অতিবৃদ্ধি ও শিল্পের প্রভাবে বাড়ছে গ্রীনহাউস গ্যাস। সাদা বরফে কালো কার্বনের আস্তরণ পড়ছে, যা সূর্যের তাপ শোষণ করে ত্বরান্বিত করছে হিমবাহ বিস্ফোরণ।বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন— বরফের নীচে চাপা পড়ে থাকা কোটি কোটি ভাইরাস যদি মুক্ত হয়, তার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে।লাদাখে ৯৭% মানুষই আদিবাসী এবং প্রায় ৭৫% বৌদ্ধ। অথচ এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ— সূর্যকিরণ,ইউরেনিয়াম, মেঙ্গানিজ, ক্রোমিয়াম,এমনকি সোনা ও অন্যান্য বিরল খনিজ পদার্থ— এখন কর্পোরেট স্বার্থের টানে সরকারের ‘উন্নয়ন প্রকল্পে’ পরিণত হচ্ছে।স্থানীয় মানুষ আশঙ্কা করছেন, ষষ্ঠ তপশিলের সুরক্ষা ছাড়া এই মাটিও বেনিয়াদের দখলে চলে যাবে।
প্রকৃতি রক্ষায় যিনি বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত, সেই সোনম ওয়াংচুক আজ রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বন্দি। তাঁর সহকর্মী ও অনুগামীরাও একই ভাগ্য বরণ করছেন। লাদাখের দাবিকে এখন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে রূপ দিতে মরিয়া প্রশাসন।বিশ্লেষকরা বলছেন, “এ শুধু লাদাখের আন্দোলন নয়—এটি প্রকৃতি,পরিচয় ও ন্যায়ের লড়াই।”আজ লাদাখের বরফে আগুন জ্বলছে। সেই আগুন শুধু দাবির নয়, এটি এক অসন্তুষ্ট উপত্যকার আর্তনাদ—“আমাদের মাটি, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ভবিষ্যৎ বাঁচাও।”