
Oplus_131072
প্রতিনিধি রমেন্দ্র গোপ,খোয়াই
সময় পাল্টাচ্ছে। পাল্টে যাচ্ছে জীবনধারা, গ্রামীণ পরিবেশ এবং সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শন। তবুও, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির এই দ্রুতগতির যুগে কিছু মানুষ এখনো হৃদয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন গ্রামবাংলার শিকড়ের টান। তারই এক উজ্জ্বল উদাহরণ খোয়াই জেলার কল্যাণপুর ব্লকের রজনী সর্দার পাড়ার গয়াঙফাঙয়ের উপজাতি কাষ্ঠশিল্পীরা।
কাঠ দিয়ে তৈরি করা গাইল এবং ছিয়া, একসময়ের প্রতিটি গ্রামের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ, আজ প্রায় বিস্মৃত। কিন্তু এই উপজাতি কাষ্ঠশিল্পীরা শত অভাব-অভিযোগ সত্ত্বেও নিজেদের পরম্পরা ছাড়েননি। আর তা না ছাড়ার পেছনে আছে ঐতিহ্যের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধা, নিজের শিকড়কে ধরে রাখার অদম্য চেষ্টা।
শীতের সকালে গায়েত্রী সূর্যের আলো যখন গ্রামবাংলার উঠোনে এসে পড়ে, তখন পিঠেপুলির গন্ধে মেতে ওঠে প্রতিটি বাড়ি। পৌষ সংক্রান্তির পিঠেপুলি তৈরি হবে, কিন্তু চালের গুঁড়ো কোথায়? আধুনিক যন্ত্রের যুগে মানুষ ছুটে যায় রাইস মিলে। কিন্তু অনেকেরই মতে, চালের কলে তৈরি গুঁড়োর তুলনায় গাইল ছিয়ায় তৈরি গুঁড়ো দিয়ে পিঠেপুলির স্বাদ অন্যরকম। সেই স্বাদ যেন গ্রামবাংলার মাটি ও হৃদয়ের গন্ধ।
রজনী সর্দার পাড়ার গয়াঙফাঙয়ের কাঠশিল্পীদের ঘরে এখন কাজের ধুম। কাঠের গন্ধে ভরে ওঠা তাদের উঠোনে তৈরি হচ্ছে গাইল ছিয়া। একসময়ের অভিজাত এই বস্তুটি এখন শুধু ঐতিহ্যের স্মারক। দামও বেশি নয়—পনেরোশো থেকে ষোলশো টাকা। কিন্তু কষ্টের কাজ! কাঠ কেটে, মাপ মিলিয়ে, নিপুণ হাতে তৈরি করা গাইল বানানো যেন এক ধৈর্যের পরীক্ষা।
কাষ্ঠশিল্পীরা বলছেন, “এটা আমাদের পূর্বপুরুষদের পেশা। বাপ-ঠাকুরদা এ কাজ করেছেন। আমাদের হাতেই সেই শিল্প বাঁচানোর দায়িত্ব। কিন্তু জানি না, আমাদের ছেলেমেয়েরা এই কাজ শিখবে কি না। চেষ্টা করছি শেখানোর, কিন্তু তাদের আগ্রহ কম।”
তাদের কণ্ঠে হতাশার সুর থাকলেও চোখে এক অসম্ভব গর্বের দীপ্তি। গাইল ছিয়া শুধু একটা বস্তু নয়, এটা যেন তাদের শিকড়, তাদের ইতিহাস। পৌষ পার্বণের আগে এই ঐতিহ্যের চাহিদা কিছুটা বাড়ে। লোকজন খোঁজ করে, কেনে। তাদের মতে, “কষ্ট করলেও কিছু বিক্রি হয়। ঐতিহ্য ধরে রাখার পাশাপাশি পেটের ভাতও জোটে।”
সভ্যতার অগ্রগতির ঢেউ আমাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে। কিন্তু কিছু মানুষ এই বদলে যাওয়ার মধ্যেও আগলে রেখেছেন গ্রামীণ সনাতনী ঐতিহ্যের শেষ কণা। গয়াঙফাঙয়ের উপজাতি কাষ্ঠশিল্পীদের গাইল ছিয়া তাই শুধু এক বস্তু নয়, এটি হারিয়ে যাওয়া গ্রামবাংলার প্রাণের স্পন্দন।
আমাদের উচিত তাদের এই প্রচেষ্টাকে সম্মান জানানো, তাদের কাজকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করা। কারণ এই শিল্প শুধু তাদের নয়, এটি আমাদের সবার ঐতিহ্য, আমাদের শিকড়।