
প্রতিনিধি অনুপম পাল,কৈলাসহর
আলো সবসময় আলোর দিক থেকেই আসে না। কখনও কখনও, অন্ধকারের ভিতর থেকেও জ্বলে ওঠে এক একটি দীপ্ত শিখা। তেমনই এক মেয়ের নাম অঙ্গিতা চন্দ—ঊনকোটি জেলার কৈলাসহরের কাচরঘাট এলাকার এক কোণঠাসা ঘরের আশ্চর্য দীপ্তি। দারিদ্র্য, শোক আর অসহায়তার গভীর অন্ধকারে থেকেও যে নিজের জীবনকে রঙিন স্বপ্নের ক্যানভাসে আঁকতে জানে।
এই বছর উচ্চমাধ্যমিকে কলা বিভাগে ৪২৭ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে অঙ্গিতা। কাগজে-কলমে হয়তো এই নম্বরটি ৯০ শতাংশের নিচে—কিন্তু যদি জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে হিসাব করা হয়, তাহলে সে শতকরা একশোরও বেশি পাওয়ার যোগ্য। কারণ প্রতিটি নম্বরই তার রক্ত, ঘাম, আর অশ্রু দিয়ে গড়া।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার মায়ের আকস্মিক প্রয়াণ যেন থমকে দিয়েছিল অঙ্গিতার ছোট্ট দুনিয়া। বাবার মুখে আজও সেই দুঃসহ ক্ষতর ব্যথা রয়ে গেছে। দীর্ঘ অসুস্থতায় কর্মক্ষমতাহীন হয়ে পড়া সেই বাবাই আজ শুধুই বিছানার একজন নীরব সহচর। সংসার নামের দৈত্যের সামনে দাঁড়িয়ে, অঙ্গিতা হয়ে উঠেছে রোজকার জীবনের এক সাহসী যোদ্ধা। হাতে বই, আর কাঁধে পরিবারের দায়িত্ব—এই দুইয়ের ভারে মাথা নিচু হয় না, আরও ঋজু হয় তার মেরুদণ্ড।
প্রতিদিন নিজের পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে সে কয়েকটি টিউশনি করে। তার উপার্জনেই চলছে বাবার ও দশম শ্রেণির ছাত্রী ছোট বোন অনামিকার খাবারের ব্যবস্থা। অনামিকা এখন কৈলাসহর উচ্চতর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ছে—স্বপ্ন দেখে সে-ও একদিন বড় হবে, ঠিক যেমন তার দিদি লড়ছে আজ।
তবে স্বপ্ন যতই উজ্জ্বল হোক, বাস্তবতার শেকল তাকে টেনে ধরে। অর্থাভাবের কুয়াশা তাকে প্রতিনিয়ত অগ্রযাত্রায় বাধা দিচ্ছে। এই সময় তার দরকার একটু আশ্রয়, একটু ভরসা, একটু সাহস—সরকারি সহায়তা কিংবা সহৃদয় কোনও প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে হয়তো সে আবার আকাশ ছোঁয়ার পথে পা বাড়াতে পারবে।
অঙ্গিতার জীবন কেবল একটি হতদরিদ্র কিশোরীর সংগ্রামের গল্প নয়, এটি এক অনবদ্য প্রতীক—যেখানে কষ্টের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে সাহসের রুপালি রেখা। তার চোখে এখনো স্বপ্ন আছে, তার হৃদয়ে এখনো আলো জ্বলে। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ যদি একটু করে এগিয়ে আসে, তবে হাজারো অঙ্গিতার মুখে ফিরতে পারে হাসি, জ্বলতে পারে আরও অনেক আলো।
আমরা যদি চোখ মেলে তাকাই, দেখতে পাবো—কাচরঘাটের সেই ক্ষুদ্র ঘরটির এক কোণে বসে একটি মেয়ে স্বপ্ন বুনছে, বইয়ের পাতায় পাতায় ভবিষ্যতের ছবি আঁকছে। আমাদের সহানুভূতি, আমাদের সহযোগিতাই হতে পারে সেই রঙ, যা দিয়ে সে ছবিটিকে পূর্ণতা দিতে পারবে।
আজ, আমাদের সমাজের কাছে প্রশ্ন একটাই—আমরা কি সেই ছবি আঁকার রঙ হব?