দ্যা ইউনাইটেড ত্রিপুরা প্রতিনিধি অনুপম পাল,জীবন কখনও একমুখী নদী নয়, তার স্রোত বয়ে চলে ভিন্ন পথে। কেউ কেউ বড় বড় ডিগ্রি নিয়ে বিলাসবহুল অফিসে বসে, আবার কেউ মাটির গন্ধ মেখে ঘামে ভেজা শরীরে রচনা করে স্বপ্নের গল্প। রাষ্ট্রবিজ্ঞান স্নাতক হয়ে মুটেগিরি করতে থাকা এক তরুণের জীবন তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণ।
এই তরুণের চোখে ছিল হাজারো স্বপ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বইয়ের পাতা ওল্টানোর সময় কল্পনা করতেন এক ভিন্ন জীবন, যেখানে কাজের মাঝে থাকবে বুদ্ধি, জ্ঞান আর মননের মেলবন্ধন। কিন্তু জীবন তো সবসময় কল্পনার পথে হাঁটে না। বাস্তবতা তাকে নামিয়ে দিল রুক্ষ মাটির পথে। স্নাতক পাস করেও চাকরির বাজারে হাহাকার, চারপাশে হতাশার ধোঁয়া। কিন্তু থেমে যাওয়া তো তার রক্তে নেই।
জীবিকার তাগিদে মুটেগিরি বেছে নিয়েছেন তিনি। হয়তো এই কাজ সমাজের চোখে ততটা সম্মানের নয়, কিন্তু তার কাছে এটা একটা লড়াই। মাথার ঘাম পায়ে ফেলেই রোজকারের রোজগার। তবে এই পরিশ্রমও তাকে স্বপ্ন দেখতে ভুলতে দেয়নি। প্রতিদিন ক্লান্ত শরীরে যখন ঘরে ফেরেন, তখন তার হাতে থাকে নতুন দিনের লক্ষ্য। বইয়ের পাতায় ডুবে থাকেন, ভেবে নেন কীভাবে নিজের জীবনের দিকটা আরও উজ্জ্বল করা যায়।
“কাঁধে AK-47” সাধারণ কথার আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটি অসাধারণ স্বপ্ন। বিহারের বৈশালী জেলার মিঠুন কুমার মাহাতো। পেশায় দিনমজুর, তবে মননে এক অক্লান্ত স্বপ্নবাজ। কৈলাসহরের মাটিতে রোজ সিমেন্টের বস্তা নামানোর মতো কঠিন পরিশ্রমে দিন কাটে তার। কিন্তু এই কঠোর বাস্তবতার আড়ালে লুকিয়ে আছে তার এক অনন্য লক্ষ্য—দেশের সেবায় নিজেকে উত্সর্গ করা। প্রায় ৬বৎসর পূর্বে পরিবারকে দারিদ্রতা থেকে কিছুটা মুক্ত করতে বিহার রাজ্য থেকে সোজা এসেছেন কাজের খোঁজে কৈলাসহর। মা,বাবা,তিন বোন সহ ছয় জনের পরিবার। ঘরের হাল ফেরাতে এবং বোনেদের বিয়ের খরচায় বাবা মাকে কিছুটা সাহায্য করতে এসে এখানে শুরু করেন মুটেগিরি। প্রতিদিন চার থেকে পাঁচশত টাকা আয় হলেও নিজে আধপেটা থেকেও প্রতি মাসে বাড়িতে পরিবারের জন্য পাঠাচ্ছেন ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। বেশ কিছুদিন হয়েছে বোনেদের বিয়ে হয়েছে।
২০১৯ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ইলেকট্রিক্যালে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করা এই তরুণ আজ ট্রাক থেকে সিমেন্টের বস্তা নামায়। অথচ তার জীবনের প্রধান লক্ষ্য একটাই—সেনা বাহিনীতে যোগ দেওয়া। জীবনের এই কঠিন পরিস্থিতিও তার মনোবলকে দমাতে পারেনি। প্রতিদিনের কাজের পাশাপাশি সকালে মাঠে দৌড়ানো, শারীরিক কসরত করা এবং ফাঁকে অনলাইনে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াই তার দিনলিপি।
আমাদের প্রতিনিধির সাথে কথা বলতে গিয়ে মিঠুন জানায় মাস কয়েক আগে একটি সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। সেখানে মাত্র ৪ নম্বরের জন্য সুযোগ হাতছাড়া হয়। পরীক্ষার কাট-অফ মার্ক ছিল ৬২, আর সে পেয়েছিল ৫৮। “স্যার, ম্যাথসে থোড়া উইক হ্যায়,”—একটু আক্ষেপ ছিল তার কথায়। কিন্তু সেই আক্ষেপ তাকে থামিয়ে দিতে পারেনি। বরং প্রতিটি ব্যর্থতা তাকে আরও লড়াই করার প্রেরণা জোগায়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে মোবাইলে খান স্যারের অনলাইন ক্লাস করছে বলে জানায়।
মিঠুনের দিন কাটে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে। গায়ে সিমেন্টের ধুলো, হাতে ফোসকা, আর মুখে একটাই কথা,“একদিন কাঁধে AK-47 নিয়ে দেশের সেবা করব।” তার এই অদম্য ইচ্ছাশক্তি জীবনের সব প্রতিকূলতাকে হার মানায়। শারীরিক পরিশ্রম তার কাছে বাধা নয়,বরং তা তার স্বপ্নপূরণের পথকে আরও দৃঢ় করে তুলছে। আগামী বৎসর জানুয়ারী মাসে আবারো সর্বভারতীয় পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি চালাচ্ছে বলে জানায় সে। ছবি দেখতে খুব ভালোবাসে,তবে অনুপ্রেরণা দেয় এমন ছবিই বেশি পছন্দ বলে জানায় মিঠুন। প্রিয় ছবির কথা জিজ্ঞেস করতেই সে জানায়, ১২ ফেইল ছবিটি তার কাছে অত্যন্ত প্রিয়।
মিঠুনের মতো তরুণদের কাহিনি শুধু অনুপ্রেরণার নয়, এক গভীর দায়িত্ববোধেরও বার্তা বহন করে। সমাজের একটি অংশ যখন শখ আর আরামে বিভোর, তখন মিঠুনের মতো ছেলেরা তাদের রক্ত-ঘামে ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়ে তুলছে। আমাদের উচিত তাদের পাশে দাঁড়ানো। একটু সহযোগিতা, একটু দিকনির্দেশনা হয়তো বদলে দিতে পারে এই তরুণের জীবন।
মিঠুন শুধু একজন দিনমজুর নন, তিনি একজন যোদ্ধা। জীবনের কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও তার স্বপ্ন হারিয়ে যায়নি। তিনি জানেন, স্বপ্ন পূরণ করতে গেলে পরিশ্রম, ব্যর্থতা এবং অধ্যবসায়ের পথ পাড়ি দিতে হয়। তার কাহিনি আমাদের শেখায়, “কোনও স্বপ্নই ছোট নয়।” মিঠুনের স্বপ্ন একদিন বাস্তবে রূপ নেবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।