কৈলাসহরের মাটিতে যেন ছড়িয়ে আছে ইতিহাসের গন্ধ। প্রতিটি ধুলিকণা, প্রতিটি ইটের গাঁথুনি বয়ে বেড়াচ্ছে শতাব্দীর স্মৃতি। শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার উত্তরে পা বাড়ালেই চোখে পড়বে রাজন্য আমলের নীরব সাক্ষী, এক অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহ্যের নিদর্শন।
একসময় এই অঞ্চল ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। আভিজাত্য, স্থাপত্যের অনবদ্য কারুকাজ আর সংস্কৃতির জৌলুস আজও যেন বাতাসে মিশে আছে। এই সবকিছুই যেন অতীতের রাজকীয় ইতিহাসের নীরব কথক।
স্মৃতির পৃষ্ঠায় ফিরে তাকালে দেখা যায়, কৈলাসহর ছিল একসময়ের রাজধানী। কিন্তু আজকের প্রজন্ম কি জানে সেই ইতিহাস? জানে কি কিভাবে এই মাটি বয়ে এনেছিল এক সমৃদ্ধ রাজত্বের স্মারক? সময়ের আবরণে ঢাকা পড়ে গেছে অনেক কিছু। তবে ইতিহাসের পাতায় যতই ধুলো জমুক, কৈলাসহরের এই নিদর্শনগুলো আজও বলে যায় পুরোনো কীর্তিগাথা।
তাই এই প্রজন্মের কাছে কাছে কৈলাসহরের সমৃদ্ধ ইতিহাস তুলে ধরতেই আজকের এই প্রতিবেদন। চলুন মাটির কাছাকাছি গিয়ে জানি আমাদের শিকড়ের কথা। কৈলাসহরের এই স্মৃতিচিহ্নগুলো শুধু অতীত নয়, বরং আমাদের গর্বের প্রতীক। এ যেন রাজ্যের ইতিহাসের এক সোনালী অধ্যায়, যা জানতে পারলে হয়তো আমরা আরও সমৃদ্ধ হব।
ত্রিপুরার ইতিহাসের পটভূমিতে কৈলাসহরের রাঙাউটি এক সমৃদ্ধ অধ্যায়ের সাক্ষ্য বহন করে। এটি কেবল একটি জনপদ নয়, বরং ত্রিপুরার প্রাচীন রাজন্যযুগের এক অমূল্য নিদর্শন। ‘রাজমালা’র দ্বিতীয় লহর (পৃঃ ১৫২)-এর তথ্য অনুযায়ী, রাঙাউটি একসময় ত্রিপুরার রাজধানী ছিল। মহারাজা দ্বিতীয় ইন্দ্র মানিক্যের শাসনামলে (১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) এই জনপদ তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শিখরে পৌঁছায়। তাঁর নেতৃত্বে রাঙাউটিতে রাজবাড়ি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার নামানুসারে সেই অঞ্চল পরিচিতি পায় ইন্দ্রনগর নামে। আজও এই গ্রাম তার ঐতিহাসিক পরিচয় বহন করে চলেছে।
রাজবাড়ির শৌর্য-বীর্যের গল্প আজ অনেকাংশেই কালের গর্ভে বিলীন, কিন্তু এখনও কিছু নিদর্শন অতীতের স্মৃতি জাগ্রত করে। ‘রাজার দীঘি’, সাত কানি বিস্তৃত একটি জলাশয়, সেই সোনালি দিনের অবশেষ হিসেবে টিকে আছে। দীঘির পাড়ে পোড়া ইটের পরিকল্পিত ঘাটের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়, যা সেই সময়ের উন্নত স্থাপত্যকলার সাক্ষী। জলাশয়ের দক্ষিণে ‘কামান গোলা’ নামক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য নির্মিত হয়েছিল। এছাড়া, পোড়া মাটির প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ ইঙ্গিত দেয় যে, রাজবাড়িটি ছিল অনেক বৃহৎ এবং সুসজ্জিত।
কিন্তু কেন এই রাজধানী পরিত্যক্ত হলো? ইতিহাসের বিবরণ থেকে জানা যায়, রাঙাউটির পতনের প্রধান কারণ ছিল একদিকে ‘খচাক’ নামক জঙ্গি গোষ্ঠীর ক্রমাগত আক্রমণ এবং অন্যদিকে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এই বিপর্যয়গুলো জনপদটিকে অরক্ষিত করে তোলে এবং ফলে রাজধানী অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়। তবে, প্রাচীন রাজধানীর স্মৃতি মুছে গেলেও এখানকার চতুর্দশ দেবতার পূজার্চনা আজও জীবিত। মাঘী পূর্ণিমায় বার্ষিক মেলা হয়, যা ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
রাঙাউটির এই গৌরবময় ইতিহাস শুধুমাত্র অতীতের ধ্বংসাবশেষ নয়, বরং ত্রিপুরার রাজন্যযুগের চেতনার একটি প্রতীক। কৈলাসহরের প্রাচীন রাজত্বের স্মৃতি তার সমৃদ্ধ সংস্কৃতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। রাঙাউটির ঐতিহাসিক গুরুত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের উচিত এই ইতিহাস সংরক্ষণ করা। প্রাচীন স্থাপত্য ও ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ এবং প্রচারের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মকে এই গৌরবময় ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত করা সম্ভব।
কৈলাসহরের রাঙাউটি ত্রিপুরার রাজন্যযুগের একটি অনন্য নিদর্শন, যা যুগ যুগ ধরে আমাদের ঐতিহ্যের গর্ব হয়ে বেঁচে থাকবে। এটি কেবলমাত্র অতীতের এক শহর নয়, বরং এক প্রাচীন সংস্কৃতির ধারক-বাহক, যা আমাদের অতীতের শিকড়ের কথা মনে করিয়ে দেয়।
স্থানীয় বাসিন্দা গোপাল নাথ, কাঞ্চন দেবনাথ এবং ইয়ামিছ আলি—তাঁরা সকলেই যেন এক স্বরে বললেন, “রাজার দীঘি” রাজন্য আমলের এক অমূল্য স্মৃতিচিহ্ন। দীঘির স্থির জলরাশি আর চারপাশের সবুজ প্রকৃতি যেন ইতিহাসের অতীত গল্পগুলো আজও মধুর সুরে শোনায়। প্রতিবছর বহু পর্যটক এখানে আসেন, এই ঐতিহাসিক নিদর্শনের সাক্ষী হতে। শহরের কাছাকাছি থেকে অনেকেই ছুটে আসেন ইতিহাসের গন্ধ মাখা এই দীঘির মায়ায়।
তবে এখানকার অপ্রশস্ত ও অনুন্নত রাস্তা যেন একমাত্র অন্তরায়। পর্যটকদের সংখ্যা সেভাবে বাড়ে না, আর এর ফলে এলাকার মানুষের আর্থিক সম্ভাবনাও সীমাবদ্ধ থেকে যায়। স্থানীয়দের দাবি—যদি দীঘির সংলগ্ন এলাকায় একটি অতিথি নিবাস গড়ে তোলা হয় এবং রাস্তার উন্নয়ন করা হয়, তবে এ জায়গাটি পর্যটকদের প্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে। পর্যটকের আনাগোনা বাড়লে স্থানীয়দের আয়ের নতুন পথও খুলে যাবে।
রাজ্য সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং সঠিক পরিকল্পনার স্পর্শে এই রাজকীয় স্মৃতির দীঘি যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে। সময়ের স্রোত বয়ে গেলেও, তার অন্তর্নিহিত মহিমা যেন নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছায়—এই আশায় বুক বেঁধেছেন এখানকার মানুষ। “রাজার দীঘি” তখন কেবল ইতিহাস নয়, হয়ে উঠবে বর্তমান ও ভবিষ্যতের গৌরবময় সংযোগস্থল।
প্রতিনিধি অনুপম পাল
কৈলাসহর,ঊনকোটি ত্রিপুরা