
Oplus_131072
প্রতিনিধি অনুপম পাল,কৈলাসহর
সময়ের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের কিছু অংশ কখনো সম্পূর্ণ মুছে যায় না, বরং এক অলৌকিক উপস্থিতি নিয়ে থেকে যায় মানুষের মনে, প্রকৃতির বুকে। ত্রিপুরার প্রাচীন শৈবতীর্থ ঊনকোটি ঠিক তেমনই এক স্থান—যেখানে প্রতিটি শিলাচিত্র, প্রতিটি দেবমূর্তি যেন হাজার বছরের ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। এই স্থানেরই নিকটবর্তী জনপদ কৈলাসহর, যার নাম নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, এর শিকড় গভীরভাবে শিব-আরাধনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
কেউ বলেন “কৈলাসহর”, কেউ আবার “কৈলাশহর”—কোনটি সঠিক? কিন্তু নামের উচ্চারণগত পার্থক্যের বাইরে, এই জায়গার অস্তিত্বই যেন এক মহান ঐশ্বরিক কাহিনি বহন করে।
ঊনকোটি শব্দের অর্থ ‘এক কোটি থেকে এক কম’—কেন এই নাম? কিংবদন্তি বলে, একসময় এখানে স্বয়ং মহাদেব এক কোটি দেবতার সঙ্গে কৈলাসযাত্রার উদ্দেশ্যে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। কিন্তু সকলে সময়মতো জাগতে ব্যর্থ হলে, শিব ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের পাথরে পরিণত করেন। সেই থেকেই ঊনকোটি এক রহস্যময় তীর্থক্ষেত্র হয়ে ওঠে, যেখানে হাজার হাজার শৈবমূর্তি, খোদাইকৃত দেবচিত্র আজও বিস্ময় জাগায়।
সবচেয়ে বিখ্যাত হল ঊনকোটি শিবমূর্তি, যা “উনকোটি কাল ভৈরব” নামে পরিচিত। এই বিশাল শিলাচিত্রে মহাদেবের মহিমা ফুটে উঠেছে, যা দেখলে মনে হয়, দেবতা নিজেই যেন এই পাথরের গায়ে ভাস্বর হয়ে আছেন। রয়েছে মহিষমর্দিনী দুর্গা, গণেশ, নন্দী ও অন্যান্য মূর্তিও, যাদের বিস্ময়কর স্থাপত্য ও শৈলী আজও এক রহস্যের মোড়কে ঢাকা।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—কে তৈরি করল এই মূর্তিগুলো? কিছু মানুষ মনে করেন, এটি রাজা বিষ্ণুমানিক্যের আমলের সৃষ্টি, আবার কেউ বলেন, কোনো এক দেবশিল্পী এক রাতের মধ্যে এগুলো তৈরি করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি। সত্য যা-ই হোক, ঊনকোটি আজও এক অধরা রহস্য, এক অতিপ্রাকৃত অনুভূতি।
ঊনকোটির কাছেই যে শহরটি গড়ে উঠেছে, তার নাম কৈলাসহর—এই নামেও কি শিবের আশীর্বাদ মিশে নেই?
রাজন্য ত্রিপুরার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ধনঞ্জয় ঠাকুরের মতে, “কৈলাসের হর” থেকে এসেছে কৈলাসহর। অর্থাৎ, এটি একসময় শিবের ধ্যানে নিমগ্ন স্থান ছিল। শৈবতত্ত্বের ব্যাখ্যায় ‘হর’ মানে শিব, আর ‘কৈলাস’ তো মহাদেবের স্বর্গীয় অধিবাস। সেই সূত্র ধরে, এই শহরের নাম যেন স্বয়ং মহাদেবের উপস্থিতিরই ইঙ্গিত বহন করে।
কিন্তু এর আরেকটি ব্যাখ্যায় পাওয়া যায়, একসময় এখানকার বিস্তীর্ণ জলময় এলাকায় প্রচুর রাম কলার বন ছিল। সেই “কলা” আর “হাওর” মিলে নাম হয়েছিল “কলা-হাওর”, যা সময়ের প্রবাহে হয়ে যায় “কৈলাসহর”।
আরও একটি ব্যাখ্যায় উঠে আসে, এখানে একসময় কয়লার খনি ছিল। ব্রিটিশ আমলের এক রিপোর্টেও এই তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাই অনেকে মনে করেন, “কয়লা-সার” থেকে “কৈলাসহর” নামটির উৎপত্তি হতে পারে।
তবে যেভাবেই এই নামের সৃষ্টি হয়ে থাকুক না কেন, একে অস্বীকার করা যাবে না যে কৈলাসহর শিবের কৃপাধন্য এক শহর।
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক মাধ্যমে এক নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে—শহরের নাম কি “কৈলাসহর” নাকি “কৈলাশহর”? শহরের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা নিজেদের মতামত দিচ্ছেন, কেউ বলছেন “কৈলাসহর” সঠিক, কেউ আবার মনে করেন “কৈলাশহর” বলাটাই প্রকৃত উচ্চারণ।
কিন্তু সত্যি বলতে, নামটা কী হবে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হল এই নামের পেছনে যে আধ্যাত্মিক শক্তি ও ঐতিহ্য লুকিয়ে আছে, তা রক্ষা করা। ঊনকোটির প্রাচীন শৈবতীর্থ, শিবমূর্তির গভীরতা, রহস্যময় সৃষ্টি ও কৈলাসহরের আধ্যাত্মিক পরিবেশ—এই সবকিছুকে সংরক্ষণ করাটাই মূলত প্রয়োজন।
ঊনকোটির নিস্তব্ধ প্রকৃতি, খোদাইকৃত দেবমূর্তির চাহনি, কৈলাসহরের শান্ত আকাশ—সব মিলিয়ে এটি শুধু একটি শহর নয়, এটি এক আধ্যাত্মিক আবহমণ্ডল। আজও এখানে এলে মনে হয়, যেন মহাদেব নিজে এই ভূমিকে আশীর্বাদ করেছেন।
কৈলাসহরের বাতাসে মিশে আছে ঊনকোটির দেবমূর্তির ইতিহাস, পাথরে পাথরে গাঁথা আছে অজানা শিল্পীর অপূর্ণ স্বপ্ন, শিবের মহিমা আজও এখানে ধ্বনিত হয়—নাম যতই বদলাক, বিশ্বাস অটুট থাকুক। কৈলাসহর শুধু একটি নাম নয়, এটি শিবের আশীর্বাদে গড়ে ওঠা এক পবিত্র ভূমি, যেখানে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্ম একসঙ্গে মিলেমিশে এক অনন্য কাহিনি বলে যায়।