প্রতিনিধি নিজস্ব
আগরতলা,পশ্চিম ত্রিপুরা
মেলাঘরের ঐতিহ্যবাহী বটতলী পৌষ সংক্রান্তি মেলা—যা যুগ যুগ ধরে বাঙালি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের সৌহার্দ্যের প্রতীক ছিল, সেই মেলাকে কলঙ্কিত করল গতকালের এক লজ্জাজনক ঘটনা। বাঙালি এক যুবকের বিরুদ্ধে উপজাতি সম্প্রদায়ের এক মেয়েকে স্পর্শ করার অভিযোগ এনে শুরু হওয়া উত্তেজনা মূহুর্তেই অশান্তিতে রূপ নেয়। অভিযোগ সত্য হোক বা মিথ্যা, এর জেরে যে চরম নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে তা মানবিকতার প্রতিটি সীমা লঙ্ঘন করেছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ওই বাঙালি যুবককে উপজাতি সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ ঘিরে ধরে মারধর করতে শুরু করে। পরিস্থিতি এতটাই হাতের বাইরে চলে যায় যে পুলিশকে লাঠিচার্জ করে ছেলেটিকে রক্ষা করতে হয়। যুবককে থানায় নিয়ে যাওয়ার পরও উত্তেজনা থামেনি। উল্টো, মেলার দায়িত্বে থাকা পুলিশের উপর উপজাতি জনতা সরাসরি আক্রমণ করে। শুধু পুলিশ নয়, বাঙালি দোকানপাট এবং সাধারণ মানুষকেও লক্ষ্য করে মদ্যপানের বোতল নিক্ষেপ করা হয়।
এই ঘটনা শুধুমাত্র এক ব্যক্তির আচরণের প্রতিক্রিয়া ছিল না; বরং এটি একটি বৃহত্তর আক্রমণাত্মক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। মেলায় থাকা বাঙালি দোকানদারদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে হামলা চালানো হয়। দোকানপাট ভাঙচুর, মানুষকে হেনস্থা করা—এসব কার্যক্রম সভ্য সমাজের মুখে চপেটাঘাত।
মেলাঘর মেলা বরাবরই উপজাতি ও বাঙালির মিলনের সেতুবন্ধন। কিন্তু গতকালের এই ঘটনায় প্রমাণ হলো যে, সমাজের একটি অংশ এখনও সহাবস্থানের ধারণা বুঝতে পারেনি। বাঙালি যুবকের কাজ যদি ভুল হয়েও থাকে, তাহলে তার বিচার করার দায়িত্ব আইন এবং প্রশাসনের। কিন্তু সম্পূর্ণ একটি সম্প্রদায়কে টার্গেট করে তাদের উপর চড়াও হওয়া, দোকান ভাঙচুর করা, এবং পুলিশের উপর হামলা চালানো—এগুলো অযৌক্তিক, অসভ্য এবং চরম নিন্দনীয়।
প্রশাসনের দায়িত্ব ছিল মেলার শান্তি বজায় রাখা, যা তারা সম্পূর্ণভাবে করতে ব্যর্থ হয়েছে। পুলিশের উপর হামলা করার পরেও কেন এখনও পর্যন্ত দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি? এই ধরনের ঘটনাগুলো ভবিষ্যতে বারবার ঘটবে, যদি অপরাধীরা শাস্তি থেকে রেহাই পায়।
এই ঘটনা আমাদের একবার নয়, বারবার ভাবায়—আমরা কি সত্যিই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দিকে এগোচ্ছি? নাকি অন্ধ সাম্প্রদায়িকতার দিকে ফিরে যাচ্ছি? এভাবে একটি গোষ্ঠীকে টার্গেট করে আক্রমণ করলে সমাজে বিভাজন আরও গভীর হবে।
মেলাঘরের পৌষ সংক্রান্তি মেলার এই লজ্জাজনক অধ্যায় ইতিহাসের কালো পাতা হয়ে থাকবে। এটি শুধুমাত্র একটি সহিংসতার ঘটনা নয়, বরং সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা বিদ্বেষের প্রমাণ। প্রশাসনকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সেইসাথে, আমাদের সমাজের মানুষকে বুঝতে হবে, সহাবস্থানই একমাত্র পথ। এমন নৈরাজ্য যদি বারবার ঘটে, তবে মেলা, উৎসব, সংস্কৃতি—সবই একদিন কেবল অতীতের গল্প হয়ে যাবে।