
প্রতিনিধি অনুপম পাল
কৈলাসহর,ঊনকোটি ত্রিপুরা
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে চৌদ্দ দেবতা পূজো কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং এটি এক গভীর আস্থার প্রতিফলন, যা যুগ যুগ ধরে মানুষের বিশ্বাসের বাতিঘর হয়ে রয়েছে। কৈলাসহর রাঙ্গাউটি গ্রামের এই ঐতিহ্যবাহী পূজো ও মেলা তার ১৭৪তম বর্ষে পদার্পণ করল, এবারও ভক্তি, সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির এক অপূর্ব সংযোগ গড়ে তুলতে।
আজ, পূজোর শুভ সূচনায় প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন রাজ্যের সমাজ শিক্ষা ও সমাজ কল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী টিংকু রায়। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ঊনকোটি জেলা পরিষদের সভাধিপতি অমলেন্দু দাস, মহকুমা শাসক প্রদীপ সরকার, কৈলাসহর পুর পরিষদের চেয়ারপারসন চপলা দেবরায়,ভাই চেয়ারপারসন নীতিশ দে,প্রাক্তন সাংসদ রেবতী ত্রিপুরা,গৌরনগর পঞ্চায়েত সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান বদরুজ্জামান,চন্ডীপুর পঞ্চায়েত সমিতির চেয়ারম্যান সম্পা দাস পাল,বিশিষ্ট সমাজ সেবক বিমল কর সহ বিশিষ্টজনেরা।
গতকাল থেকেই পুণ্যার্থীরা দেবতাদের চরণে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করতে হাজির হন মন্দির প্রাঙ্গণে।
মন্ত্রী টিংকু রায় তাঁর বক্তব্যে বলেন, “এই পূজো ও মেলা শুধু ত্রিপুরার নয়, এটি সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতের সম্প্রীতির এক সেতুবন্ধন। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের অংশগ্রহণই এই উৎসবের আসল সৌন্দর্য।” তিনি আরও জানান যে, মন্দিরের উন্নতিকল্পে বেশ কিছু নতুন প্রস্তাব হাতে নেওয়া হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এই মন্দির সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান মিলনস্থলে পরিণত হয়।
ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এবারের পূজোয় আয়োজন করা হয়েছে মহাপ্রসাদ বিতরণের। পূজোর পর খিচুড়ি ভোগ সকল ভক্তদের মধ্যে বিতরণ করা হয়, যেখানে জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করেন। কোনো বিভাজন নয়, বরং একসঙ্গে ভোজনের মাধ্যমে মানবতার ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা ছড়িয়ে দেয় এই আয়োজন।
পূজোর পাশাপাশি চৌদ্দ দেবতা মেলাও হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও আনন্দ-উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। লোকশিল্প ও হস্তশিল্পের প্রদর্শনী, ঐতিহ্যবাহী খাবারের দোকান, বিভিন্ন খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মুখরিত হয়ে উঠেছে মেলার মাঠ। ভক্তদের ভিড়ে পূর্ণ হয়ে উঠেছে প্রতিটি স্টল, যেখানে ঐতিহ্যবাহী খাদ্য ও হস্তশিল্পের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা।
এই পূজো ও মেলা কেবলমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিফলন নয়, এটি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির এক মহান উৎসব। যুগ যুগ ধরে চৌদ্দ দেবতা পূজো হিন্দুদের কাছে শুধু ভক্তির প্রতীক নয়, বরং শান্তি ও ঐক্যের এক আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছে। বর্তমান সময়েও যখন বিভেদ ও সংঘাত মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন এই পূজো ও মেলা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্যিকারের বিশ্বাস ও আস্থা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে, সেতুবন্ধন তৈরি করতে পারে সকলের মধ্যে।
কৈলাসহর রাঙ্গাউটির এই চৌদ্দ দেবতা পূজো ও মেলা তাই শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি বিশ্বাস, সম্প্রীতি ও ঐক্যের এক চিরন্তন উৎসব।