
প্রতিনিধি অনুপম পাল, কৈলাসহর
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে, নাটকের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা ও এক দশকের নিষ্ঠাবান পথচলা নিয়ে, রেনেসাঁ নাট্য সংস্থা আয়োজন করল তিন দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য নাট্যোৎসব “রঙ্গ পরব”। ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের সহযোগিতায়, এই উৎসব ২৭শে মার্চ বিশ্ব নাট্য দিবস উপলক্ষে নাট্যপ্রেমীদের এক অনন্য অভিজ্ঞতা এনে দিল। নাট্যচর্চার প্রাণস্পন্দন মিশে আছে এই শহরের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপত্য, লোকসংস্কৃতি ও ইতিহাসের পরতে পরতে, আর সেই ঐতিহ্যকেই নবীন সংবেদনে তুলে ধরল এই উৎসব।
উৎসবের উদ্বোধনী দিনেই শহরের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নাট্যবোদ্ধারা মঞ্চ আলো করে রেখেছিলেন। প্রথম দিন, পাথারকান্দি নাট্যজন সংস্থার পক্ষ থেকে অভিজিৎ দাসের রচনা ও নির্দেশনায় পরিবেশিত হয় “নূপুর মাঝির বৈঠা”, যেখানে অসমের বৃহত্তম বিল সনবিলের প্রেক্ষাপটে জীবনযাত্রার এক অনবদ্য চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। নাট্যশিল্পীদের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে দর্শকরা এক অন্যরকম আবেগের স্রোতে ভেসে যান। এরপর মঞ্চস্থ হয় শিশু নিকেতন স্কুলের পক্ষ থেকে অমরজিৎ সরকারের নির্দেশনায় নাটক “আর্থ ফার্ট অলয়েজ”, যেখানে পরিবেশ ও জলবায়ুর পরিবর্তনের সংকট তুলে ধরা হয় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে।
উৎসবের দ্বিতীয় দিনেও নাটকের আবহে ছিল অনুরণিত। প্রথম নাটক হিসেবে দেবাশিস রায়ের রচনা ও নির্দেশনায় “যশোমতি” দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, যেখানে এক নারীর সংগ্রামী জীবনগাথা উঠে আসে। এরপর পার্থ মজুমদারের রচনা ও নির্দেশনায় আগরতলা থেকে আগত নাট্য শিল্পীরা পরিবেশন করেন “দ্য গ্রেট এসকেপ” নাটকে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর বিপ্লবী সংগ্রামের কাহিনি ফুটে ওঠে, যা দর্শকদের মধ্যে দেশপ্রেমের অনির্বাণ শিখা প্রজ্বলিত করে।
তৃতীয় দিন ছিল এক আবেগপূর্ণ যাত্রার শেষ অধ্যায়। শিলচরের আজকের প্রজন্ম সংস্থার শায়ন বিশ্বাসের রচনা ও নির্দেশনায় পরিবেশিত হয় “তিন পুতুলের গল্প” । জীবনের সূক্ষ্ম দিকগুলোকে তুলে ধরে এক অপূর্ব বুননে দর্শকদের মন জয় করে নেয়। এরপর কোলকাতার নিত্য বিতাবিতান পরিবেশন করে “ওয়ান ফ্রাইডে মর্নিং”।রচনা ও নির্দেশনা সঞ্চিতা বসুর এই নাটকে উঠে আসে সমাজের বর্ণবৈষম্যের নির্মম বাস্তবতা, যেখানে দুর্গা সরেন নামের এক দলিত শিক্ষার্থীর আত্মপরিচয়ের লড়াই দর্শকদের হৃদয়ে গভীর দাগ কেটে যায়।
উৎসবের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে রাজ্যের সমাজ কল্যাণ ও সমাজ শিক্ষা দপ্তরের মাননীয় মন্ত্রী টিংকু রায়ের উপস্থিতি এই আয়োজনকে আরও তাৎপর্যময় করে তোলে। রেনেসাঁ নাট্য সংস্থার আহ্বায়ক রকি দাস ও সহ-আহ্বায়িকা সুইটি দাস তাঁকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করেন।
এই তিন দিনের নাট্যময় আবেশ শুধু শহরের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে সমৃদ্ধ করেনি, বরং বাংলা নাট্যচর্চার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। রেনেসাঁ নাট্য সংস্থার নিবেদন, এই নাট্য আন্দোলনের প্রাণপ্রবাহ আগামী দিনেও বহমান থাকবে, এমন আশার সুর তুলেই শেষ হলো “রঙ্গ পরব”। নাটকের আলো নিভে গেলেও তার প্রতিচ্ছবি থেকে যাবে হৃদয়ের গভীরে, স্মৃতির আয়নায়।