দ্যা ইউনাইটেড ত্রিপুরা প্রতিনিধি অনুপম পাল,কালের বিবর্তনে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে ঢেঁকি শিল্প। এক সময় গ্রামে ধান থেকে চাল আর চাল থেকে চালের গুড়ো প্রস্তুতের একমাত্র মাধ্যম ছিল ঢেঁকি। এক সময় গ্রামীন এলাকায় সবার মুখে মুখে শুনা যেত “ও বউ ধান ভানে রে ঢেঁকিতে পার দিয়া”। পায়ে নূপুরের মিষ্টি মধুর আওয়াজ আর ঢেঁকির পাড়ে গ্রাম্য বধূদের গান,সে এক অন্য অনুভূতি। শীতের মরশুমে রকমারি পিঠে তৈরী হত গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে। ঢেঁকি দিয়ে তৈরী করা চালের গুড়ো দিয়েই গ্রামের প্রতিটি ঘরে প্রস্তুত করা হতো পুলি, ভাপা, পাটিসাপটা ছাড়াও নানান ধরনের পিঠা-পুলি। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আশির দশক থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে ঢেঁকি শিল্প। বর্তমান নব প্রজন্মের কাছে ঢেঁকি শব্দটি শুধুমাত্র যেন একটি গল্পের মতো। আর তাই নব প্রজন্মের কাছে পুরোনো ঐতিহ্য তুলে ধরতেই আজকের এই প্রতিবেদন।
কংক্রিটে মোড়া শহর থেকে পুরোনো ঐতিহ্যকে খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে সমরুরপাড় পঞ্চায়েত এলাকায়। তবে তার আগে কৈলাসহর মহকুমার কলাছড়া, ভগবাননগর, শ্রীরামপুর পেড়িয়ে কোথাও যখন পুরোনো ঐতিহ্যকে খুঁজে পাচ্ছিলামনা তখন মনে একপ্রকার জেদ চেপে গেল। আজ খুঁজে বের করতেই হবে পুরোনো এই ঐতিহ্যকে। মনু নদী পেরিয়ে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে যখন এগিয়ে যাচ্ছিলাম রাস্তায় দেখা হয়েছে অনেক অন্যদাতাদের সাথে। প্রায় ৭০ উর্ধ্ব এক বৃদ্ধ, হাতে লাঠি নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। দেখে মনে হল উনাকে ঢেঁকির বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে হয়তো এদিকে কারো বাড়িতে ঢেঁকি আছে কি না সেটা জানা যাবে। গাড়িটা দাড় করিয়ে একটু সামনে গিয়ে বললাম “কাকু আপনার বাড়ি কি, ইখানেই”? সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এল,”বাবু তোমারেতো ইখানো কোনো দিন দেখছিনা’। উত্তরে বললাম, আমি এই যায়গাতে এর আগে এক/দুইবার আইছি, কিন্তু তখন হয়ত আপনার লগে দেখা হইছেনা, আজকে দেখা হইল। “কিতার লাগিয়া আইছ”? ইকটু ঠাট্টা করে বললাম আমরা রূপকথার গল্পের সন্ধানে বেড়িয়েছি। যদি আপনার স্মৃতির গহীনে ডুব দিয়ে আনতে পারি মূল্যবান মনি মুক্ত। কাকু আমরা আমাদের পুরোনো ঐতিহ্য, ঢেঁকির খুঁজে বেড়িয়েছি। উনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলে” ঠিক ওই কৈছো, ঢেঁকি আজকে রূপ কথার গল্পই”। উনার থেকে জানা যায় ঢেঁকির বিবরণ, লম্বায় সাড়ে তিন থেকে চার হাত, আর পৌনে এক হাত চওড়া ঢেঁকি তৈরি করতে দরকার পড়তো ভালো মানের বরই, বাবলা অথবা জাম গাছের কাঠ। ঢেঁকির মাথার দিকটা একটু পুরু এবং অগ্রভাগ সরু। সামনের দিকে বসানো হতো এক হাত পরিমাণের কাঠের দস্তা। দস্তার মাথায় লাগানো হত লোহার গুলা। এই গুলা মাটির যে অংশ কে স্পর্শ করে সেখানে গর্ত খুঁড়ে তৈরী করা হতো গড়। এই গড়ের মধ্যেই ভানতো ধান, চাল ও চিড়ে কখনো-সখনো আবার নানান মশলা। কিন্তু তিনি আক্ষেপ এর সুরেই জানালেন এখন আর নেই সেই সোনালী সময়।
গ্রামীণ এলাকার আরো ভিতরের দিকে যেতে যেতে অনেককে জিজ্ঞেস করলেও কেউ সন্ধান দিতে পারলেন না। অনেকের বক্তব্য,”বড় বাড়িতে খোঁজ নেন, পাইলেও পাইতে পারেন”। আমরা ছুটলাম এবার সীমান্ত ঘেঁষা বড় বাড়ির খোঁজে। বাড়িটি খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি যদিও। বড় বাড়ি বলতে সেখানকার নমঃ পদবির যে বাড়ি সেটা বুঝে উঠতে বেশি সময় লাগেনি আমাদের। তিন ভাইয়ের দুভাই শহরের দিকে চলে এলেও বাড়ির বড় ছেলে আঁকড়ে পরে আছে পৈতৃক ভিটেটি।
আমরাও বড় বাড়ির উঠোনে পা রেখে বুজতে পারলাম, শুধু ভিটেটিই আঁকড়ে রেখেছেন তেমন না। রাখতে চেয়েছেন পুরানো ঐতিহ্য, পৈতৃক স্মৃতি চিহ্ন। আমাদের দেখা হলো বাড়ির গৃহিণী সুশান্তি নমঃ এর সাথে। উনাকে ঢেঁকির কথা জিজ্ঞেস করতেই একটু অবাক চোখে তাকিয়ে তিনি আমাদের নিয়ে গেলেন ঢেঁকি ঘরের সামনে। চোখে পড়লো আসার পথে দেখা কাকুর বিবরণ অনুযায়ী, তিন চার হাত লম্বা ঢেঁকির উপর। দেখেই মনে হলো কত জনমের স্মৃতির বয়ান বুকে চেপে একাকী বিশ্রামরত শুয়ে আছে সে। সুশান্তি দেবী বললেন “এইডা আমার শাশুড়ি মায়ের স্মৃতি এর লাইগ্গা অনেক যুদ্ধ কইরা সযত্নে টিকাইয়া রাখছি”। উনার বয়ানে,এই ঢেঁকিটি উনার শ্বশুর মশাই উনার শাশুড়ি মায়ের জন্যে নিজ হাতে বানিয়ে দিয়েছিলেন খুব সম্ভবত ১৯৬৭/৬৮ সালে। এক সময় উনাদের উঠোনে মেলা বসত, চৈত্র সংক্রান্তি হোক কিংবা আশ্বিন কার্তিক মাসে নবান্নের আগে। এখন আর তাদের এই ঢেঁকিটি দিয়ে আগের মত কাজ করা যায় না। স্মৃতি রক্ষার জন্যই, ঢেঁকিটি যত্নে রেখেছেন উনারা।
উনাকে বললাম,আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমাদের গ্রামীন এই ঐতিহ্য আজকে বিলুপ্তির পথে। তিনি জানান, ‘দেখইন, আধুনিকতার ছোঁয়া যে আমারার গ্রামে লাগছেনা এমন নায়। তবে আমরার ঐতিহ্য কইন আর বড় বাড়ি হিসেবে পরিচিত পুরানা স্মৃতিই কইন তারে বাঁচাইয়া রাখতে পারলেই তো আমরার পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবো। তাঁরা যদি নাই জানে তাদের কৃষ্টি,সংস্কৃতি ঐতিহ্যের প্রতি আন্তরিক হইবো কেমনে‘ ?
বাঙালির পিঠের-পুলির সাথে অঙ্গাঙ্গি ভাবে সম্পৃক্ত এই ঐতিহ্যের নিদর্শন ঢেঁকি। আশ্বিন-কার্তিক মাসে কৃষকেরা যখন দল বেঁধে ধান কেটে ঘরে ফিরত, কৃষক গৃহিনীর তখন ব্যস্ততার শেষ নেই। মা লক্ষ্মীকে বরণ করে গোলায় তুলতে হবে ধান। প্রতিটি বাড়ির শিশু-কিশোর থেকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলের জীবনে লাগতো তখন আনন্দের ছোঁয়া। এ যে নবান্ন উৎসব। প্রায় প্রতিটি ঘর থেকে সুর ভেসে আসতো ঢেঁকি পেটার গানের। বহু রাত অবধি পাল্লা দিয়ে চলতো পিঠে তৈরীর কাজ। গ্রামের বাতাস মুখরিত থাকতো পিঠে পুলির মম করা সুবাসে। এক গ্রামের পিঠেপুলির গন্ধ ছড়িয়ে পড়তো অন্য গ্রামে।
তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আশির দশক থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে ঢেঁকি। ইঞ্জিন চালিত যন্ত্রের কাছে হার মানতে হয়েছে ঢেঁকির ধুপুর-ধাপুর শব্দ। এক সময় গ্রামীণ জনপদ মুখরিত ছিল ঢেঁকির এই শব্দ অথবা কৃষক গৃহিণীর দের ঢেঁকির তালে তালে বাঁধা নানান সুরের গান,কবিতা। আজ সবই অতীত। ঢেঁকির সাথে হারিয়ে যাচ্ছে বাঙালির লোকজ শিল্প।
সময়ের সাথে মানুষ যত প্রযুক্তি নির্ভর হচ্ছে আরোও অনেক বিষয়ের সাথে সাথে বিলীন হচ্ছে গৃহস্থ বাড়ির নানান মধুময় দৃশ্যপট। খানিক ছন্দহীন আজকের গ্রামীন জীবন প্রকৃতি। ধান ভাঙার দৃশ্য, উঠোন জুড়ে আলপনা,বৃদ্ধ/বৃদ্ধাদের দের পানের বাটা নিয়ে আড্ডার আসর আর ঢেঁকির তালে তালে গান, এসব যেন কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে এখন। আজ বড্ড অচেনা হয়ে গেছে গ্রামীণ ঐতিহ্যের চির চেনা সেই ঢেঁকি।