
Oplus_131072
প্রতিনিধি অনুপম পাল
কৈলাসহর,ঊনকোটি ত্রিপুরা
কৈলাসহর দশমীঘাট সংলগ্ন বাগদেবীর মূর্তির চোখে তুলির শেষ আঁচড় দিচ্ছেন মৃত শিল্পী শুভেন পাল। হাতে কাদা, মুখে হতাশা। অথচ একসময় এই হাত দিয়েই তৈরি হতো অপূর্ব মৃৎশিল্প, যা উপাসকের মনে এনে দিতো শ্রদ্ধা, শিল্পবোদ্ধার মনে আনন্দ। কিন্তু আজ?
আজ সেই তুলির টান যেন ভারী হয়ে উঠেছে বাজারদরের উর্ধ্বগতির চাপে। মাটি, বাঁশ, কাঠ, রঙ, তুলি—সবকিছুর দাম বেড়েছে, কিন্তু শিল্পীদের উপার্জন কমেছে। কৈলাসহর চন্ডীপুর বিধানসভার অন্তর্গত শ্রীরামপুর এলাকার ১নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা শুভেন পাল দীর্ঘ ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়েও এবার নিরাশ। বছর বছর প্রতিমার দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই, অথচ মানুষের হাতে টাকা কম। মন্দির-মন্ডপের আয়োজকরা বাজেট কমিয়ে দিয়েছেন। ফলাফল? অর্ডার কমছে, শিল্পী সংকটে পড়ছেন।
তিনি একরাশ হতাশা নিয়ে বলেন, “এতো দাম বাড়লে আমরা শিল্পী থাকবো কীভাবে? কাজ করেও তেমন লাভ হয় না। আগের মতো প্রতিমা বানাতে গেলে নিজের পকেট থেকেই টাকা গুনতে হয়।”
শিল্পের ভাষা চিরন্তন, কিন্তু শিল্পীর জীবনের ভাষা যেন আজ শুধুই লড়াই। কৈলাসহরের এই মৃৎশিল্পীদের দিন কাটে কাদা-মাটির গন্ধে, তাদের হাতে জন্ম নেয় দেবী, আর তার পরেই শুরু হয় আরেক যুদ্ধ—প্রতিমা বিক্রির যুদ্ধ। একদিকে ক্রমবর্ধমান উপকরণের দাম, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অভাব। সরস্বতী পুজো মানেই শিক্ষার আলো, সৃষ্টির উৎসব—কিন্তু যে হাত প্রতিমা গড়ে, সেই হাতেরই আজ যেন লেখা নেই।
শুভেন পালের মতো অনেক কারিগর রয়েছেন, যারা বছরের পর বছর প্রতিমা গড়ে সংসার চালান। কিন্তু এখন এই পেশার ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁরা চিন্তিত। এক তরুণ কারিগর বলেন, “নতুন প্রজন্ম এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছে, কারণ এতে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা চাই সরকার আমাদের সাহায্য করুক, নাহলে কয়েক বছর পর এই শিল্প হয়তো বিলুপ্ত হয়ে যাবে।”
মৃৎশিল্পীদের জন্য বিশেষ ভর্তুকি বা অনুদানের ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে তারা উপকরণ সহজলভ্য মূল্যে কিনতে পারেন।প্রতিমা ও মৃৎশিল্পের প্রচার ও বিপণনের জন্য আধুনিক বিপণন কৌশল গ্রহণ করা দরকার, যাতে শিল্পীদের কাজ আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায়।
শিল্পীর হাত থেকে উঠে আসা প্রতিমার চোখে যখন প্রাণ আসে, তখন যেন স্রষ্টার হাতও তাঁর আশীর্বাদ দিয়ে যায়। কিন্তু যদি শিল্পীর চোখেই অনিশ্চয়তা ভর করে, তবে কি শিল্প টিকবে? সরস্বতীর আরাধনা শুধু শিক্ষার নয়, সৃষ্টিরও উৎসব। তাই শুধু প্রণাম নয়, শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্বও আমাদের সবার।