দ্যা ইউনাইটেড ত্রিপুরা প্রতিনিধি অনুপম পাল!একান্নবর্তী পরিবার আমাদের সামাজিক ঐতিহ্যের এক অনন্য নিদর্শন। পরিবারে একসঙ্গে কয়েকটি প্রজন্ম একত্রে বসবাসের মাধ্যমে পারস্পরিক বন্ধন ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায়। এই পরিবেশে পরিবার শুধু বাসস্থান নয়, বরং একটি ছোট্ট সমাজ যেখানে মূল্যবোধ, আদর্শ, এবং পরস্পরের প্রতি যত্নবোধ তৈরি হয়। তবে বর্তমান সময়ে একান্নবর্তী পরিবার চোখে পড়েনা বললেই চলে , এবং এর অন্যতম কারণ সমাজে আন্তরিকতা ও ঐকান্তিকতার অভাব।
একান্নবর্তী পরিবার বলতে বোঝায় একটি বাড়িতে একাধিক প্রজন্মের সদস্যদের একসঙ্গে বসবাস, যেখানে পরিবারের প্রতিটি সদস্য একে অপরের সুখ-দুঃখের অংশীদার হন। এতে করে বিভিন্ন বয়সের মানুষের অভিজ্ঞতা, শিক্ষা এবং মানসিক বিকাশ ঘটে। এর ফলে সন্তানদের সঠিক পথনির্দেশনা ও আদর্শ মূল্যবোধ প্রদান সম্ভব হয়। এছাড়াও, একান্নবর্তী পরিবারে আর্থিক দায়িত্বের বোঝা ভাগাভাগি হয়ে যায় এবং একসঙ্গে থেকে তারা উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে।
কিন্তু বর্তমান যুগে একান্নবর্তী পরিবার যেন বিলুপ্তির পথে। বিভিন্ন কারণের জন্য বর্তমানে একান্নবর্তী পরিবার কমে আসছে। তার মধ্যে অন্যতম কারন হিসেবে যে গুলো চোখে পড়ে সেগুলি হল, ১) আধুনিক জীবনযাত্রা এবং কর্মক্ষেত্রের পরিবর্তনের কারণে শহরে বসবাসের প্রবণতা বৃদ্ধি । চাকরি বা ব্যবসার খাতিরে তরুণ প্রজন্ম গ্রাম থেকে শহরে চলে যাচ্ছে এবং একান্নবর্তী পরিবার ছেড়ে নিউক্লিয়ার পরিবার গঠন করছে। ২) বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা নিজস্ব জীবনযাত্রা, শখ, ও পছন্দমতো চলতে চায়, যা একান্নবর্তী পরিবারের নিয়মিত ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ব্যক্তিগত মতভেদ ও সংঘাত এড়াতে অনেকেই আলাদা বাসস্থানে থাকতে পছন্দ করেন। ৩) একান্নবর্তী পরিবারে সম্পদ ভাগাভাগি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মতানৈক্য হতে পারে। সম্পত্তি এবং আয় বণ্টনের বিষয়ে মতপার্থক্য পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটায়, ফলে তারা আলাদা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।৪) বর্তমান সমাজে ব্যক্তি স্বার্থ ও নিজের জীবনকেন্দ্রিক মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আন্তরিকতা ও ঐকান্তিকতার অভাব সৃষ্টি করছে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তরিকতা না থাকলে এবং একে অপরের প্রতি নিষ্ঠা না থাকলে একান্নবর্তী পরিবারের গুরুত্ব হারায়।
একান্নবর্তী পরিবারে সন্তানেরা বিভিন্ন বয়সের মানুষের সঙ্গে থেকেছে এবং মূল্যবোধ শিখেছে, কিন্তু নিউক্লিয়ার পরিবারে এই সুযোগ দিন দিন যেন হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে।
একান্নবর্তী পরিবারে বড়রা সন্তানদের যত্ন নেন এবং তাদের বিকাশের পাথেয় হন। ছোট পরিবারে এই সহযোগিতা অনেকাংশে কম পাওয়া যায়, ফলে সন্তানদের মানসিক বিকাশে প্রভাব পড়ে।
একান্নবর্তী পরিবারে বয়স্কদের সঙ্গে পরিবারের সবাই থাকে, কিন্তু নিউক্লিয়ার পরিবারে বয়স্কদের একা থাকতে হয়। এর ফলে তাদের মধ্যে একাকিত্ব ও মানসিক অশান্তি বৃদ্ধি পায়।
একান্নবর্তী পরিবারের মূল্যবোধ টিকিয়ে রাখতে সমাজে আন্তরিকতা ও ঐকান্তিকতার বিকাশ প্রয়োজন। এর জন্য কিছু উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে, যেমন, পারিবারিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করতে নিয়মিত একসঙ্গে সময় কাটানো।পারিবারিক উৎসব বা বিশেষ দিনগুলিতে একত্রিত হওয়া।বিভিন্ন পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সব সদস্যকে যুক্ত করা।
একান্নবর্তী পরিবার আমাদের সমাজে আন্তরিকতা, ঐকান্তিকতা, ও মূল্যবোধের প্রতীক। বর্তমান সমাজে এর বিলুপ্তি আমাদের মানসিক ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। একান্নবর্তী পরিবারের ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ ধরে রাখার জন্য আমাদের আন্তরিকতা ও ঐকান্তিকতার মনোভাবকে বৃদ্ধি করতে হবে এবং একে অপরের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। এতে করে আমাদের সমাজ আরও মানবিক এবং মজবুত হবে।