
Oplus_131072
প্রতিনিধি অনুপম পাল
কৈলাসহর,ঊনকোটি ত্রিপুরা
রাতের নিস্তব্ধ জঙ্গলে একসময় শোনা যেতো বন্যপ্রাণীদের ডাক, বাতাসের দোলায় দুলতো বিশাল সবুজ গাছপালার পাতা। এখন সেই ডাক ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে, পাতারা যেনো নিঃশব্দ কান্নায় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। গাছের সারির বদলে দাঁড়িয়ে আছে ধূসর, প্রাণহীন রাবার বাগান।
প্রকৃতির বুক চিরে গড়ে উঠেছে কৃত্রিম সবুজের রাজ্য—যেখানে বৃষ্টি আসে, কিন্তু তা আর আগের মতো সজীবতা আনে না। সেখানে হরিণ আর লাঙ্গুরের দৌড়ঝাঁপ নেই, নেই বাঁদরের লাফালাফি। শুধু এক অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতা, যা মনে করিয়ে দেয় মানুষের সীমাহীন লোভের গল্প।
ত্রিপুরার গভীর জঙ্গলে বসবাসকারী ক্যাপড লাঙ্গুর ও স্পেক্টাকলড বানর আজ এক চরম খাদ্য সংকটে। যেসব বহেরা, আড়সুন্ডা বা অন্যান্য বনজ গাছের পাতা ছিল তাদের প্রধান খাদ্য, সেগুলো হারিয়ে গেছে। এখন তাদের সামনে যা রয়েছে, তা শুধুই রাবার বাগানের বিষাক্ত সবুজ।
শুধু কি লাঙ্গুর? পাখি, হরিণ, বনবিড়াল—সবাই আজ অসহায়! বন ধ্বংসের ফলে তারা তাদের স্বাভাবিক খাদ্য পাচ্ছে না, বাধ্য হয়ে লোকালয়ে ঢুকছে। আর তখনই মানুষ তাদের দেখে বলে, “বন্যপ্রাণীরা উন্মত্ত হয়ে উঠছে!”
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে মানুষ নিজেই। উন্নয়নের মোহে সে ভুলে গেছে, একটি গাছ কাটা মানে কেবল একটি গাছ হারানো নয়, বরং একটি বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হওয়া!
রাবার চাষ ত্রিপুরার অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু এই চাষের ফলে সত্যিকার অর্থে আমরা কী হারাচ্ছি?
১৯৬০-এর দশক থেকে ত্রিপুরার বনাঞ্চলে বহিরাগত গাছের আগ্রাসন শুরু হয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হলো রাবার গাছের বিস্তার। ধীরে ধীরে এই গাছের নিচে কিছুই জন্মাতে পারছে না। মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে, পাখিরা তাদের বাসা বাঁধতে পারছে না, ছোট প্রাণীদের খাবার সংকট তৈরি হচ্ছে।
রাবার বাগানের বিস্তারে কি সত্যিই ত্রিপুরার মানুষ লাভবান হচ্ছে? নাকি শুধুই কিছু শিল্পপতির পকেট ভারী হচ্ছে?
প্রকৃতি কখনও কারও ঋণ নেয় না। যা কিছু তাকে দেওয়া হয়, সে তা ফিরিয়ে দেয়। আমরা গাছ কেটে ফেলছি, জঙ্গল ধ্বংস করছি, জলাভূমি শুকিয়ে দিচ্ছি—প্রকৃতি এসব মনে রাখছে।
দিন দিন তাপমাত্রা বাড়ছে, খরা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে, বন্যা-ভূমিকম্প বেড়ে চলেছে। ত্রিপুরায় আগের মতো বৃষ্টি হয় না, ছোট নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। এ সবকিছুই প্রকৃতির প্রতিশোধ নেওয়ার ইঙ্গিত।
যদি আমরা এই ধ্বংসযজ্ঞ থামাতে না পারি, তাহলে হয়তো একদিন আমাদের সন্তানরা স্কুলের বইতে পড়বে— “একসময় ত্রিপুরায় ক্যাপড লাঙ্গুর ছিল!”
এখনো সময় আছে! আমাদের উচিত রাবার বাগানের পাশাপাশি স্থানীয় বনজ গাছ রোপণ করা বাধ্যতামূলক করা। প্রতিটি রাবার প্ল্যান্টেশনের পাশে অন্তত ৩০% বনাঞ্চল সংরক্ষণ করা দরকার, যাতে প্রাণীরা বাঁচতে পারে।
ত্রিপুরার জন্য “আগর গাছ” একটি দারুণ বিকল্প হতে পারে। এটি শুধু অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়, এটি পাখি ও প্রাণীদের জন্যও সহায়ক।
সর্বোপরি, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন মডেলের দিকে যেতে হবে। শুধুমাত্র অর্থনীতির কথা ভাবলে, প্রকৃতি একদিন আমাদের শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেবে।
আমরা যদি এখনো না সচেতন হই, তাহলে একদিন হয়তো আমাদের সন্তানেরা কৃত্রিম অক্সিজেন ট্যাঙ্ক নিয়ে বাঁচবে, কাগজের ছবি দেখে বনের গল্প শুনবে!
“আমরা কি সত্যিই এতটাই স্বার্থপর যে, নিজেদের সুবিধার জন্য পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীদের নিঃশেষ করে ফেলবো?”
সময়ের কাছে আমাদের খুব বেশি সময় নেই। এখনই উদ্যোগ নিতে হবে, নইলে আমাদের অস্তিত্বও কেবল ইতিহাস হয়ে যাবে!