
প্রতিনিধি অনুপম পাল
কৈলাসহর,ঊনকোটি ত্রিপুরা
নাটক শুধু বিনোদন নয়, এটি সমাজের দর্পণ, সংস্কৃতির স্পন্দন। কৈলাসহর, ত্রিপুরার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিশেষ ভূমিকা রাখে, বারবার তার সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে প্রমাণ করেছে শিল্প ও সাহিত্যের আলোয়। সেই ধারাবাহিকতায় নির্ঘোষ নিক্কণ নাট্য সংস্থা তাদের ২৬তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজন করেছিল তিনদিনব্যাপী নাট্যোৎসব “নাট্য মিলন ২০২৫”। ঊনকোটি কলাক্ষেত্রের প্রেক্ষাগৃহ সাক্ষী থাকলো এক অনন্য সাংস্কৃতিক আবহের।
এই মহোৎসবের শুভ উদ্বোধন করেন ত্রিপুরা বিধানসভার অধ্যক্ষ বিশ্ববন্ধু সেন। তার সঙ্গে বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন জেলা শিক্ষা আধিকারিক প্রশান্ত কিলিকদার, ভাইস চেয়ারম্যান কৈলাসহর পুরপরিষদ নীতিশ দে, নাট্য সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও রাজ্য তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য বিদ্যুৎজিত চক্রবর্তী, এবং আহ্বায়ক পল্লব গোস্বামী। সভাপতিত্ব করেন নির্ঘোষ নিক্কণের সভাপতি পীযূষ চন্দ্র শীল।
উদ্বোধনী দিনের সন্ধ্যায় যখন আলো জ্বলে উঠলো, তখন দর্শকের মনে জাগলো এক শিহরণ। এই উৎসব শুধু নাটকের উৎসব নয়, বরং কৈলাসহরের মঞ্চনাট্যের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধার্ঘ্য।
প্রথম সন্ধ্যায় নাট্যদল কথাচিত্র, ধর্মনগর পরিবেশন করলো “অপারপথ”। সমাজের বাস্তব চিত্রকে তুলে ধরার মাঝে ছিল শৈল্পিক ছোঁয়া, সংলাপে ছিল তীক্ষ্ণতা।
দ্বিতীয় সন্ধ্যায় মঞ্চস্থ হলো দুটি নাটক। “রাজারামের লটারি” (প্রযোজনা: কলাভূমি, আগরতলা) মানুষের লোভ ও কপালজয়ের এক চিত্র, আর “শঠে শ্যাঠং” (প্রযোজনা: রাঙ্গামাটি, আগরতলা) প্রতারণার জটিল খেলাকে চমৎকারভাবে তুলে ধরল দর্শকদের সামনে।
তৃতীয় দিনটি ছিল স্বপ্নময়। শিশুদের জন্য পরিবেশিত নাটক “ছুটি” এক কোমল অনুভূতির জন্ম দিলো, আর মনোজ মিত্র রচিত নাটক “দন্তরঙ্গ” (প্রযোজনা: নির্ঘোষ নিক্কণ) দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করল নাটকের গভীর বার্তায়।
নাট্যোৎসবের প্রতিটি সন্ধ্যায় নাটকের আগে ছিল এক বর্ণময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নৃত্যসংস্থা নুপুর ও ঘুঙ্গুর, আবৃত্তি সংস্থা বর্ণমালা তাদের অনবদ্য পরিবেশনার মাধ্যমে নাট্যোৎসবের আবহকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। প্রত্যেক শিল্পীর নিখুঁত উপস্থাপনা যেন কৈলাসহরের মাটিতে নতুন করে শিল্পের শিকড় গেঁথে দিল।
কৈলাসহর বরাবরই সংস্কৃতির উর্বরভূমি। এখানকার প্রতিটি গলি, প্রতিটি মঞ্চ শোনায় নাটকের গৌরবময় ইতিহাস। নির্ঘোষ নিক্কণের ২৬ বছরের পথচলা এই নাট্যঐতিহ্যেরই এক উজ্জ্বল অধ্যায়। তাদের নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী ও নাট্যপ্রেমীরা কৈলাসহরের নাট্যমঞ্চকে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
“নাট্য মিলন ২০২৫” শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, এটি ছিল নাট্যপ্রেমীদের জন্য এক নবজাগরণের অধ্যায়। এই তিনদিন নাটকের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল কৈলাসহর। দর্শকরা শুধুমাত্র নাটক দেখেননি, তারা অনুভব করেছেন প্রতিটি সংলাপ, প্রতিটি চরিত্রের গভীরতা।
নাট্যজগতে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য এই উৎসবে অমিতাভ নাগ এবং পিকলু ঘোষ-কে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হয়। তাঁদের দীর্ঘদিনের নাট্যসাধনা, মঞ্চে অবিস্মরণীয় অভিনয় এবং নাট্যকলার উৎকর্ষ সাধনে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। প্রথম,দ্বিতীয় ও তৃতীয় সন্ধ্যায় মঞ্চ উৎসর্গ করা হয় যথাক্রমে টেলিভিশন অভিনেতা প্রয়াত অতুল পারচুরের,রতীশ মজুমদার ও মনোজ মিত্রের নামে।
কৈলাসহর আবার প্রমাণ করলো—এটি শুধুমাত্র একটি শহর নয়, এটি নাটকের এক মহারঙ্গভূমি। নাটক বেঁচে থাকবে, সংস্কৃতি জাগ্রত থাকবে, কৈলাসহর আরও একবার গেয়ে উঠবে নাট্যজীবনের গান।