
প্রতিনিধি অনুপম পাল। কৈলাসহর
যেখানে সারা রাজ্যজুড়ে ‘ন্যাশনাল ডক্টরস ডে’ পালিত হচ্ছে ডাক্তারদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধের প্রতীক হিসেবে, সেখানে ঊনকোটি জেলার একমাত্র জেলা হাসপাতালের বর্তমান চিত্র যেন সেই ভাবনার প্রতি এক নির্মম ব্যঙ্গ। চিকিৎসা নয়, যেন মৃত্যুর আতঙ্ক ছড়িয়ে রয়েছে প্রতিটি দেয়াল, করিডোর ও বাথরুমে। আর রোগীদের মুখে শুধুই বিষাদ আর অভিযোগ।
ভগবাননগরে অবস্থিত জেলা হাসপাতালের ভৌত পরিকাঠামো ও পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থা এখন প্রশ্নের মুখে। হাসপাতালের চারপাশে শয়ে শয়ে প্লাস্টিকের ব্যাগে আবর্জনা ফেলে রাখা, ছড়ানো খালি জলের বোতল, ওষুধের ফাঁকা কৌটো আর ভাঙা অ্যাম্বুলেন্স—সব মিলিয়ে এক অব্যবস্থার পুঞ্জিভূত চিত্র।
হাসপাতালে আসা এক রোগীর অত্তীয়া বললেন,”এখানে সুস্থ হয়ে ওঠা নয়, বরং সুস্থ মানুষই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বাথরুমে গেলে গন্ধে বমি আসে। হাসপাতালের বাইরের নর্দমাও এর চেয়ে ভালো।”
হাসপাতালের ভিতরটাও একইভাবে ভগ্ন। ড্রেসিং রুম থেকে সাপে কামড়ানো রোগীর জরুরি যন্ত্রপাতির ব্যবস্থাপনাও নষ্ট হতে বসেছে, কারণ দক্ষ কর্মীকে সম্প্রতি অজানা কারণে অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে মাঝেমধ্যেই রোগী পরিষেবা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। রোগীদের অভিযোগ—অপারেশন থিয়েটারে থাকা ওষুধ থাকা সত্ত্বেও এক চিকিৎসক বাইরের দোকান থেকে ওষুধ কেনার জন্য প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিচ্ছেন আত্মীয়দের হাতে। সূত্র জানায়, বিষয়টি নিয়ে হাসপাতালের এমএস একাধিকবার সেই চিকিৎসককে সতর্ক করলেও কোনো পরিবর্তন হয়নি।আরও বিস্ময়ের বিষয়, হাসপাতালের জেনেরিক মেডিসিন কাউন্টার এখনো চালু হয়নি। ফলে রোগীদেরকে বাধ্য হয়ে বাইরের দোকান থেকে চড়া দামে ওষুধ কিনতে হচ্ছে, যার বোঝা গিয়ে পড়ছে সরাসরি সাধারণ মানুষের পকেটে।প্রশাসনিক অব্যবস্থার আরেকটি চিত্র উঠে আসে মেট্রনের ডিউটি ঘিরে। স্থানীয়দের অভিযোগ, জেলা হাসপাতালের মেট্রন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যেই বিদায় নেন, যেখানে ত্রিপুরা রাজ্যে মেট্রনের দায়িত্বকাল নির্ধারিত সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।তদুপরি, ধর্মাচরণ নিয়ে বিতর্কে নাম জড়িয়েছে এক ওয়ার্ড মাস্টারের। তিনি প্রতিদিন তার ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কর্মঘণ্টায় ৩-৪ জন সহকর্মীকে সঙ্গে করে বেরিয়ে যান। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে তাঁরা ফিরে এলেও ওই সময়টুকুতে পরিষেবায় মার খাচ্ছে গোটা হাসপাতাল।
আরেকটি গুরুতর সমস্যা—হাসপাতালের পাশেই চলছে বিটুমিন পোড়ানো কাজ। এর কালো ধোঁয়া ঢুকে পড়ছে হাসপাতালের ওয়ার্ডে, যার ফলে রোগীদের শ্বাসকষ্টসহ নানা অসুবিধা হচ্ছে। সুত্রের খবর এমএস জেলা শাসককে এবিষয়ে জানিয়েও এখনো কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ হয়নি।
এই অবস্থার জন্য একাংশ দায় দিচ্ছে সেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে, যার মাধ্যমে বাম আমলের শেষদিকে শহরের প্রাণকেন্দ্র থেকে হাসপাতাল সরিয়ে ভগবাননগরে স্থানান্তরিত করা হয়। চিকিৎসা পরিষেবা থেকে তখনই যেন দূরত্ব তৈরি হয় সাধারণ মানুষের। আর আজ তার ফলশ্রুতি—পরিচ্ছন্নতা নেই, জবাবদিহিতা নেই, আছে শুধু ‘সিস্টেমেটিক নৈরাজ্য’।
এমন দিনে, যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ মানিক সাহা বারবার স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে ঢেলে সাজানোর কথা বলছেন, তখনই জেলার একমাত্র বড় হাসপাতালের এমন দুরবস্থা এক অদ্ভুত তামাশা মনে করিয়ে দেয়।ডক্টরস ডে’তে ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানানোর দিনে এই চিত্র যেন বলেই দিচ্ছে—”কাগজে স্বাস্থ্যোন্নয়ন, মাটিতে স্বাস্থ্য অবক্ষয়!”
প্রশ্ন রইল—এখনো কতদিন চোখ বন্ধ করে থাকবে প্রশাসন? আর কত রোগীকে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে হবে?সমাধান কি আদৌ আসবে, নাকি এই হাসপাতালই হয়ে উঠবে সরকারি ব্যর্থতার স্থায়ী প্রতীক?