
Oplus_131072
ত্রিপুরা প্রতিনিধি অনুপম পাল,পাঁচ দশক আগে যে উর্দি ছিল রক্তমাখা, সেই উর্দি আজ প্রশিক্ষকের বেশে পদ্মাপারে পা রাখতে চলেছে। যে দেশটির জন্ম হয়েছিল নিপীড়ন আর রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়ে, সেই বাংলাদেশই আজ আমন্ত্রণ জানাচ্ছে তাদের একদা শত্রুকে। পাকিস্তানি সেনা, যাদের বর্বরতায় ১৯৭১ সালের মার্চের রাত্রিতে শুরু হয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’, তারা আবারও ঢুকে পড়তে চলেছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে।
পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক সম্পর্কের এই নতুন অধ্যায় যেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতে এক গভীর আঘাত। রক্তস্নাত ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দিয়ে এ যেন নিজেদের অতীতকেই অস্বীকার করার সামিল।
ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্টে আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে পাকিস্তানি সেনার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। প্রথম দফায় প্রায় এক বছর ধরে চলবে এই প্রশিক্ষণ। পরবর্তী পর্যায়ে দেশের ১০টি সেনা কম্যান্ডে ছড়িয়ে দেওয়া হবে এই কর্মসূচি। এই প্রশিক্ষণ শুধু সামরিক নয়, বরং কৌশলগত এবং রাজনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্রেও বড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে, পাকিস্তান থেকে সামরিক সরঞ্জাম আমদানির মাত্রা লাফিয়ে বেড়েছে। ২০২৩ সালের তুলনায় তিন গুণ বেশি গোলাবারুদ, বিস্ফোরক, এমনকি ট্যাঙ্কের গোলা আমদানি করছে বাংলাদেশ। ইসলামাবাদের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠতা শুধু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় নয়, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায়ও প্রভাব ফেলছে।
ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের এই নতুন মিত্রতা ভারতের জন্য বিপদের ঘণ্টা বাজাতে পারে। শিলিগুড়ি করিডর, যা ‘চিকেনস নেক’ নামে পরিচিত, কৌশলগত দিক থেকে ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান সম্ভবত বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করবে।
অন্যদিকে, রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসবাদে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না গোয়েন্দারা। এমনকি কট্টরপন্থীদের পৃষ্ঠপোষকতায় পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর ভূমিকা আরও সক্রিয় হয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে।
শুধু পাকিস্তানের সঙ্গেই নয়, রাশিয়ার সঙ্গেও উত্তেজনা বাড়ছে ঢাকার। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে রাশিয়ার সাহায্যে শুরু হওয়া রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। এই অভিযোগে ক্ষুব্ধ মস্কো। রুশ প্রতিষ্ঠান ‘রোসাটম’ স্পষ্ট করে বলেছে, তারা এই অভিযোগের কোনো ভিত্তি খুঁজে পায়নি।
১৯৭১ সালের সেই বিভীষিকাময় সময়ের কথা মনে করলেই চমকে উঠতে হয়। অপারেশন সার্চলাইটের বর্বরতা, টিক্কা খানের নেতৃত্বে ৩০ লক্ষ নিরীহ মানুষের হত্যা, এবং লাখো নারীর সম্ভ্রমহানির ইতিহাস কখনোই ভুলবার নয়। অথচ সেই সেনারাই এখন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে আসছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন করা এই দেশের এমন সিদ্ধান্ত যেন সেই সংগ্রাম আর আত্মত্যাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এই সম্পর্কের পুনরাবৃত্তি এক গভীর অস্থিরতার ইঙ্গিত বহন করছে। পাকিস্তানের কৌশল, বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃত্বের নীতিগত পরিবর্তন, এবং ভারতের জন্য উদ্ভূত কৌশলগত চ্যালেঞ্জ—সব মিলিয়ে এই পরিস্থিতি এক অন্ধকার ভবিষ্যতের আভাস দিচ্ছে।
বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি সেনার পদচারণা শুধু একটি সামরিক প্রশিক্ষণ নয়, এটি ইতিহাসের এক গভীর পরিহাস এবং রক্তাক্ত স্মৃতির পুনর্জাগরণ।