
প্রতিবেদন সত্যজীৎ দত্ত
কৈলাসহর,ঊনকোটি ত্রিপুরা
পৌষ সংক্রান্তির ঠিক আগের দিন কৈলাসহরে পৌষ সংক্রান্তি মেলা ঘিরে যে উদ্দীপনা দেখা যায়, তার তুলনা মেলা ভার। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯১০ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত “শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত” গ্রন্থে কৈলাসহর সম্বন্ধে বলা হয়েছে, ‘বর্তমান কৈলাসহর গভর্নমেন্ট পোষ্ট অফিসটি সহ শ্রীহট্ট জেলার দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত।এই পরগণা স্বাধীন ত্রিপুরার অধীন।ইহা দীর্ঘে তিন মাইল ও প্রস্থে দুই মাইল বিস্তৃত। গ্রাম সংখ্যা ৩৬ ও জনসংখ্যা ৬০০০ মাত্র। কৈলাসহর নগরটিও বৃটিশ ও স্বাধীন ত্রিপুরার সীমা ক্ষেত্রেই অবস্থিত। ত্রিশ বৎসর যাবৎ এই শহর স্থাপিত হইয়াছে। কাতলের দীঘি নামক একটি দীর্ঘিকার চারিপার লইয়া এই ক্ষুদ্র শহর।…’ অর্থাৎ কৈলাসহর প্রাচীন জনপদ হলেও আধুনিক কৈলাসহর এর পত্তন যে ১৮৮০ খৃষ্টাব্দের আশেপাশে, একথা “শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত ” গ্রন্থের বক্তব্য অনুসারে সহজেই অনুমান করা যায়।
পুরনো নথিপত্র অনুযায়ী মহারাজা রাধাকিশোরের পুত্র মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মাণিক্যের কৈলাসহরে আগমন ঘটে ১৯১০ খৃষ্টাব্দে। উদ্দেশ্য ছিল উনকোটিতে শিবের পুজো দেওয়া। সে সময় কৈলাসহর এর বাসিন্দারা কৈলাসহর টাউনে একটি কালি মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য আবেদন জানান। সেসময় কৈলাসহরের কাচরঘাট এলাকায় একটি কালি মন্দির প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং সেই মন্দির ১৭৪৪ খৃষ্টাব্দের আশেপাশে মহারাজা কৃষ্ণ মাণিক্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বলে উল্লেখ রয়েছে। কাচরঘাট জায়গাটি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত ও জঙ্গলপূর্ণ থাকায় সেই স্হানে অবস্থিত কালি মন্দিরে নাগরিকদের যাতায়াত ছিল কষ্ট সাধ্য। ফলে কৈলাসহরের তৎকালীন কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বর্তমান টাউন কালি বাড়ির গোড়াপত্তন করেন। পাশাপাশি মহারাজার নির্দেশ অনুযায়ী শুরু হয় কালি দীঘির খনন কার্য। অবশেষে ১৯১৫ খৃষ্টাব্দের পৌষ মাসের ২৯ তারিখ কৈলাসেশ্বরী কালিকা দেবীর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হয়। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে কালিবাড়ি প্রাঙ্গণে বসে মেলা। সেই থেকে প্রতি বৎসর মকর সংক্রান্তির আগের দিন বড় মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই মেলার সুখ্যাতি কেবলমাত্র ত্রিপুরা রাজ্যেই নয় পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশেও সুবিদিত ছিল।
রাজন্য আমলের প্রামাণ্য তথ্য থেকে জানা যায়, তৎকালীন কৈলাসহর বিভাগীয় কার্যকারক শ্রী আর কে চক্রবর্তীর পক্ষে তৌজিনবীশ শ্রী ব্রজনাথ ভট্টাচার্য ৬৩১ সেহা মূলে প্রথম পূজারী শ্রীযুক্ত বিশ্বনাথ চক্রবর্তীকে মাসিক ৮ টাকায় নিযুক্তি পত্র প্রদান করেন। সেই নিয়োগ পত্রে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে,” কৈলাসহরের নূতন কালী ১৩২০ ত্রিং সালে ঘট স্হাপন হইয়া পূজা হইতেছে।”
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ডঃ সচ্চিদানন্দ ধরের লেখা থেকে আমরা জানতে পারি,” পৌষ সংক্রান্তির পূর্বদিনে কালীবাড়িকে কেন্দ্র করে ‘মেলার মাঠ’ পর্যন্ত দীর্ঘ রাত্রি পর্যন্ত এক বিশেষ হাট বা মেলা বসত। মেলাতে নানা প্রকার শীতের মাছ বিশেষতঃ বোয়াল, ঘাঘট(আড়মাছ),ঘনিয়া প্রভৃতি মাছ আমদানি হত।প্রচুর কমলালেবু ও বিশাল আকৃতির মূলা ও বেগুন বিক্রি হত। কালীবাড়ি হিন্দু বাঙালির এক বিশেষ ধর্মীয় মিলন ক্ষেত্র।’
বাঙালি হিন্দুদের পাশাপাশি অন্যান্য হিন্দু সম্প্রদায় ও মুসলমান ধর্মী মানুষদের কাছেও এই মেলা সমান জনপ্রিয়। শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও এই মেলাকে কেন্দ্র করে কৈলাসহর ও তার সন্নিহিত এলাকার মানুষের ভাবাবেগে এক ফোঁটাও ঘাটতি চোখে পড়ে না। আজও ধনী দরিদ্র মানুষ একই ভীড়ে মিলেমিশে একাকার হয়ে মেতে ওঠেন কেনাকাটায়। সবচেয়ে বড় মাছটি কেনার জন্য যেমন থাকে প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা তেমনি সামান্য কটা টাকায় বাতাসা কিংবা মুড়ির নাড়ু কিনে রাজার মতো ঘুরে বেড়ানোতেও নেই কোন বাঁধা। সব মিলিয়ে এমন অনাবিল মিলনের ক্ষেত্র খুব একটা খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।