
Oplus_131072
প্রতিনিধি অনুপম পাল
কৈলাসহর,ঊনকোটি ত্রাপুরা
মনু নদীর অনন্ত ধাবমান স্রোতের পাশে এক বিস্তীর্ণ চা-বাগান, নাম তার “কালীশাসন”। নাম শুনলেই মনে হয়, যেন কোনো দেবী-আরাধনার পবিত্র ভূমি, যেখানে দেবলোকের করুণাধারা নেমে এসেছে সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে। কিন্তু এর প্রতিটি গাছ, প্রতিটি পাতা, প্রতিটি শিরা বহন করে এক বিস্মৃত বিপ্লবের গল্প—এক বিপ্লবী সন্ন্যাসীর লড়াইয়ের পদচিহ্ন।
সে এক অন্য সময়, যখন বাংলার আকাশ রঙিন ছিল স্বাধীনতার স্বপ্নে, কিন্তু পথের বাঁধা ছিল অগণিত। শ্রীহট্ট জেলার বেগমপুরের মেধাবী তরুণ শরৎচন্দ্র চৌধুরী তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। তবে তাঁর চোখে ছিল অন্য এক দিগন্তের স্বপ্ন—এক স্বাধীন ভারতবর্ষ, যেখানে শৃঙ্খল থাকবে না, থাকবে না পরাধীনতার ভার।
কলকাতা থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে বি.এ পাশ করার পর তাঁর প্রতিভার কথা পৌঁছে যায় ত্রিপুরার মহারাজা বীরেন্দ্রকিশোর মানিক্যের কানে। রাজা তাঁকে ডেকে পাঠান, পুরস্কার স্বরূপ কৈলাসহরের মনু নদীর পশ্চিম প্রান্তে একশো কানি জমি বরাদ্দ করেন, উদ্দেশ্য—চা-বাগান প্রতিষ্ঠা। কিন্তু যে মানুষ হৃদয়ে অগ্নিমন্ত্র ধারণ করে, তাঁর কাছে অর্থনীতি নয়, দেশমাতার মুক্তিই ছিল একমাত্র ব্রত।
সেই নির্জন বনভূমি, যেখানে কুয়াশা আর সবুজের মিতালী, শরৎচন্দ্র একে বেছে নিলেন বিপ্লবীদের গোপন আশ্রয়স্থল হিসেবে। তরুণ বিপ্লবীরা আসতেন শ্রীহট্ট থেকে, প্রশিক্ষণ নিতেন অস্ত্র চালানোর, শিখতেন প্রতিরোধের কৌশল। স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে রটে গেল, এখানে চলছে “কালীর শাসন”—দেবীর অসীম শক্তির প্রভাবে এক গোপন মহাযজ্ঞ। সেই বিশ্বাসই একদিন রূপ পেল এক নামকরণে—”কালীশাসন চা-বাগান”।
১৮৯৭ সালে শরৎচন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন দেবী ভবতারিণীর মন্দির—যা একদিকে ছিল আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক, অন্যদিকে বিপ্লবের আড়াল। এখানে বসেই তিনি রচনা করলেন তাঁর কালজয়ী সাহিত্য “দেবীযুদ্ধ”—যার প্রতিটি শব্দে গর্জে ওঠে স্বাধীনতার ডাক, প্রতিটি বাক্যে জ্বলে ওঠে বিপ্লবের শিখা।
কিন্তু বৃটিশ সরকার কি এত সহজেই এই অগ্নিস্ফুলিঙ্গকে সহ্য করবে? না, তাদের গোয়েন্দারা পৌঁছে গেল গোপন সন্ধানে। ১৯০৭-১৯০৮ সালে এই খবর মহারাজার কাছেও পৌঁছায়। বৃটিশদের চাপ বেড়ে যায়, আর শরৎচন্দ্রকে ত্যাগ করতে হয় কালীশাসনের আশ্রয়।
তিনি চলে গেলেন হিমালয়ের পাদদেশে, গ্রহণ করলেন সন্ন্যাস। তবে যে হৃদয়ে দেশমাতার রক্তের প্রতিধ্বনি বাজে, সে কি নির্বাসনে শান্তি পায়? তাই তো ১৯৩০ সালের পর একাধিকবার তিনি ফিরে এসেছেন কৈলাসহরে, থেকেছেন ভাগ্নে অনঙ্গমোহন ভট্টাচার্যের বাড়িতে। হয়তো টান ছিল ফেলে আসা দেবীমন্দিরের, কিংবা হয়তো অসমাপ্ত লড়াইয়ের।
আজও কালীশাসন চা-বাগান তার ইতিহাসের পাতায় বহন করে সেই অগ্নিগাথা। ২০১৪ সালের ২রা মে চ্যাটার্জি গ্রুপ অব কোম্পানিজ নতুন করে মন্দির পুনর্নির্মাণ করেছে। কিন্তু শরৎচন্দ্রের সেই আত্মত্যাগ, সেই স্বপ্ন—সেগুলো আজও ভেসে বেড়ায় কৈলাসহরের বাতাসে, চা-বাগানের প্রতিটি গন্ধে।
এই চা-বাগান শুধু সবুজ পত্রের রাজ্য নয়, এটি এক বিপ্লবের মন্দির। বন্দুকের গর্জনই শুধু নয়, বিপ্লব গড়ে ওঠে কলমের শক্তিতেও—ঠিক যেমন করেছিলেন শরৎচন্দ্র চৌধুরী। তাঁর অনলস সাধনা, তাঁর লেখা, তাঁর স্বপ্ন আজও প্রেরণা হয়ে বেঁচে আছে কালীশাসনের প্রতিটি পত্রকোণে, প্রতিটি বাতাসের স্পর্শে।