
Oplus_0
প্রতিনিধি অনুপম পাল,কৈলাসহর
কৈলাসহর শহরের বুকে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রাচীন নিদর্শন—৪নং ওয়ার্ডের কালী বাড়ি। প্রায় দুই শতাব্দী আগে যাত্রা শুরু করা এই মন্দির আজও শুধু একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং এক গৌরবময় ইতিহাস, এক অমূল্য সংস্কৃতি ও মানুষের অন্তরের বিশ্বাসের প্রতীক। এই মন্দিরের ইতিহাস যতটা পুরনো, তার চেয়েও গভীর এখানকার মানুষের ভালোবাসা, তাদের ধর্মীয় শ্রদ্ধা এবং সামাজিক সম্প্রীতির অসাধারণ উদাহরণ।
এক বরিষ্ঠ স্থানীয় নাগরিক জানান, সেই সময় ছোট্ট একটি ঘরে দুর্গাপূজার পর দীপাবলির অমাবস্যায় হতো মা কালীর পূজা। তৎকালীন ত্রিপুরার রাজা, মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুর নিজ খরচে পরিচালনা করতেন পূজার সমস্ত আয়োজন। তখন পূজা হতো একবারই, বছরে মাত্র একটি রাতের জন্য। কিন্তু জনসমাজের আন্তরিকতা, বিশ্বাস আর মায়ের প্রতি অকুণ্ঠ প্রেম ধীরে ধীরে রূপ নেয় নিত্য পূজায়।
প্রথম মূর্তি আনা হয়েছিলো মথুরার কাশী থেকে, যার মূল্য ছিল মাত্র ৮০০ টাকা। কিন্তু সময়ের প্রকোপ সহ্য করতে না পেরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সেই মন্দির ও মূর্তি একসময় ধ্বংস হয়। তখন আবারও এগিয়ে আসেন সাধারণ মানুষ। সুবোধ দাসের নেতৃত্বে ৩৬ হাজার টাকা ব্যয়ে নতুন মূর্তি আনা হয় সেই কাশী থেকেই।
এই কালী বাড়ির ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলজ্বলে থাকে দুটি সম্প্রদায়ের সম্মিলিত অবদান। একদিকে যেমন মুসলিম সম্প্রদায়ের কসীর মান চৌধুরী ১০ গন্ডা জমি দান করেন, তেমনি হিন্দু সম্প্রদায়ের সদানন্দ কানঙ্গ দান করেন প্রায় ৭ কানি ধানিজমি, সঙ্গে বর্তমান কালী বাড়ির পুকুর ও ভিতরের আরও দুই কানি জমি। দুই ধর্মের মানুষ একত্রে দাঁড়িয়ে, ভেদাভেদ ভুলে—একটি পূজাস্থল নির্মাণে যেভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন, তা সত্যিই আজকের সমাজে এক আলোকবর্তিকা।
ধীরে ধীরে এখানে শুরু হয় দুর্গাপূজা, প্রথমে অস্থায়ী প্যান্ডেলে, পরে পরিণত হয় স্থায়ী ঐতিহ্যে। আজ থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগে নির্মিত হয় বর্তমান কালী মন্দিরটি, যার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় মনোরঞ্জন দাসকে। পুকুরের মাছ বিক্রির আয়ে চলত মায়ের নিত্য পূজার খরচ। পরবর্তীতে স্থানীয়দের উদ্যোগে গড়ে ওঠে মহাদেবের মন্দির, দুর্গামণ্ডপ ও নাটমন্দির।
তবে, যে মন্দিরটি মানুষের ভালোবাসায় গড়ে উঠেছে, সেই মন্দিরটি গত ৩৫ বছরে আর কোনো বড় সংস্কারের মুখ দেখেনি। অথচ এই মন্দির ঘিরে রয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন ইতিহাস, জনসমাজের গভীর বিশ্বাস ও সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল অধ্যায়।
আজ এই পবিত্র স্থানটির নতুন করে সংস্কার ও সৌন্দর্যায়নের দাবি জানাচ্ছেন স্থানীয়রা। তাদের আশা, রাজ্য সরকার যদি এই ঐতিহ্যবাহী মন্দিরের প্রতি সদয় দৃষ্টি দেন, তাহলে শুধুই একটি পুরনো মন্দির নয়, এক অসাধারণ ইতিহাস, একাত্মতার চিহ্ন ও মানুষের আস্থার প্রতীক আরও একবার নতুন রূপে জেগে উঠবে।
এই কালী বাড়ি কেবল পাথরের গাঁথুনি নয়—এ এক বর্ণময় সংস্কৃতির আখ্যান, এক আধ্যাত্মিক যাত্রা, আর মানুষের হৃদয়ের এক অভিন্ন স্পন্দন।