
Oplus_131072
✍️প্রতিনিধি অনুপম পাল
ত্রিপুরার ইতিহাস ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ কৈলাসহরের চৌদ্দ দেবতার মন্দির এবং এর বার্ষিক মাঘী পূর্ণিমার মেলা। শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এই মেলা হিন্দু সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতির এক অনন্য মিলনক্ষেত্র। প্রতি বছর এই পূণ্যতিথিতে লক্ষ লক্ষ ভক্ত সমবেত হন মাঘী পূর্ণিমার মেলাকে কেন্দ্র করে, তাঁদের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে চৌদ্দ দেবতার মন্দির প্রাঙ্গণ।
ঊনকোটি জেলার কৈলাসহর একসময়ে ত্রিপুরার রাজধানী ছিল এবং এখানকার রাঙাউটিতে মহারাজ ইন্দ্রমানিক্য রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। প্রাচীনকাল থেকে এই অঞ্চল দেবতাদের আশীর্বাদধন্য বলে মনে করা হয়। কাহিনি অনুযায়ী, এক বিশাল বটগাছকে কেন্দ্র করে ভক্তদের মানত করার প্রথা শুরু হয়, যা পরবর্তীতে চৌদ্দ দেবতার মন্দিরের প্রতিষ্ঠার পটভূমি তৈরি করে।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে এই মন্দির শুধু একটি উপাসনাস্থল নয়, বরং আস্থার এক শক্তিশালী কেন্দ্র। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, এখানে সশ্রদ্ধ প্রার্থনা করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়। তাই মন্দিরের বটগাছে মানতের কাপড় বাঁধার রীতি বহু যুগ ধরে প্রচলিত আছে। প্রতিদিন হাজারো মানুষের শ্রদ্ধা-ভক্তিতে মন্দির প্রাঙ্গণ এক অলৌকিক ধর্মীয় আবেশে দীপ্ত হয়ে ওঠে।
মাঘী পূর্ণিমা হিন্দু ধর্মে এক বিশেষ তিথি, যা পবিত্রতার প্রতীক। এই দিনে কৈলাসহরের চৌদ্দ দেবতার মন্দিরে বিশেষ পূজার্চনা অনুষ্ঠিত হয়। এবছর ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি, লক্ষ লক্ষ ভক্ত এই পবিত্র স্থানে সমবেত হয়ে দেবতার কৃপা প্রার্থনা করবেন।
ভক্তদের বিশ্বাস, এই দিনে দেবতাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে পাপ মোচন হয় এবং জীবনে সমৃদ্ধি আসে। তাই দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার পূণ্যার্থী এই মহোৎসবে অংশগ্রহণ করেন। মন্দির চত্বর ধূপের সুগন্ধে, শঙ্খধ্বনিতে ও আরতির মাধুর্যে এক অনন্য পরিবেশে রূপ নেয়।
এই মেলা শুধুমাত্র পূজা-অর্চনার জন্যই বিখ্যাত নয়, বরং এটি ত্রিপুরার সংস্কৃতি ও লোকজীবনের এক অপরিহার্য অংশ। মেলার প্রতিটি পর্ব ধর্মীয় আবেগ ও আস্থার সাথে সংযুক্ত।
ভক্তরা দেবতার কৃপা লাভের আশায় ব্রত পালন করেন, দান-ধ্যানে অংশ নেন এবং ধর্মীয় গান-বন্দনা করেন। মেলাকে কেন্দ্র করে ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প, মাটির মূর্তি, ধাতব অলংকার, প্রসাদ সামগ্রী এবং নানান রকমের হিন্দু ধর্মীয় উপকরণ বিক্রি হয়। যা স্থানীয় কারিগরদের জন্য এটি একটি বড় সুযোগ।
হিন্দু সম্প্রদায়ের বিশেষ ধর্মীয় স্থান হলেও ধর্মীয় বিশ্বাসের এই মিলনক্ষেত্রে ত্রিপুরার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ একত্রিত হয়ে ভক্তি ও ভ্রাতৃত্ববোধের পরিচয় দেন।
ত্রিপুরা সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের তত্ত্বাবধানে চৌদ্দ দেবতার মেলা এখন সরকারি ক্যালেন্ডারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এটি শুধু ধর্মীয় গুরুত্বই বহন করে না, বরং পর্যটন ও রাজ্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন মেলার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যাতে ভক্তরা নির্বিঘ্নে তাঁদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে পারেন।
কৈলাসহরের চৌদ্দ দেবতার মাঘী পূর্ণিমার মেলা যুগ যুগ ধরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য এক পবিত্র উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এটি শুধু তীর্থযাত্রার এক উপলক্ষ নয়, বরং বিশ্বাসের শক্তি, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার এক প্রতীক।চৌদ্দ দেবতার কৃপায় সকল ভক্তের জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণে পরিপূর্ণ হবে সেই বিশ্বাস নিয়ে আগামীকাল জনঢল নামবে বলে আশা করছেন শহরের ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ।