প্রতিনিধি অনুপম পাল,কৈলাসহর
ঊনকোটি জেলার গৌরনগর আরডি ব্লকের অন্তর্গত রাঙাউটি গ্রামের ৩০ বছর বয়সী নাজমা বেগমের মাতৃত্বযাত্রা ছিল আশা, আশঙ্কা আর সতর্কতার একটা মিশেল। প্রথমবার মা হওয়ার আনন্দ যেমন ছিল, তেমনই মনের গভীরে লুকিয়ে ছিল ভয়—কারণ অতীতে একবার গর্ভপাতের কঠিন অভিজ্ঞতা তাকে আজও তাড়া করত। কিন্তু সময়ের সঠিক সঙ্গী হয়ে পাশে দাঁড়ান স্বাস্থ্যকর্মীরা, আর সেই কারণেই শেষ পর্যন্ত এই গল্পের শেষ হয় এক সুস্থ সন্তান জন্মের হাসিতে। গর্ভধারণের প্রথম তিন মাসেই নাজমা নাম নথিভুক্ত করেন ইরানি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আওতাধীন রাঙাউটি আয়ুষ্মান আরোগ্য মন্দিরে। ২০২৫ সালের ১ মার্চ দ্রুত সম্পন্ন হয় তার প্রথম অ্যান্টিন্যাটাল চেকআপ (ANC)। কমিউনিটি হেলথ অফিসার (CHO) রিম্মি চৌধুরী তার পূর্ববর্তী গর্ভপাতের ইতিহাস শুনে বুঝতে পারেন—এই গর্ভাবস্থায় বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নেওয়ার সুযোগ নেই। তিনি নাজমাকে কাউন্সেলিং করে বোঝান নিয়মিত পরিচর্যার গুরুত্ব। এরপর থেকে দায়িত্ব পান স্থানীয় আশা কর্মী শিল্পী ধর। প্রতি মাসে ঘরে গিয়ে তিনি নাজমার রক্তচাপ, ওজন, শারীরিক পরিবর্তন—সবকিছু খতিয়ে দেখতেন। অন্যদিকে CHO রিম্মি চৌধুরী ফোনে নিয়মিত খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত করতেন যে কোন ANC যেন সময়মতো বাদ না পড়ে। সময় গড়িয়ে নয় মাস পূর্ণ হওয়ার মুখে নাজমা শেষ ANC চেকআপের জন্য কেন্দ্রটিতে আসেন। সেই দিনই CHO রিম্মির নজরে আসে বিপদের স্পষ্ট ইঙ্গিত—নাজমার পা অস্বাভাবিকভাবে ফুলে আছে।দ্রুত পরীক্ষা করে দেখা যায় পিটিং ইডিমা। আরও চিন্তার বিষয়—শিশুর নড়াচড়া বন্ধ, হৃদস্পন্দন অনিয়মিত, আর রক্তচাপ তখন বিপজ্জনক মাত্রায়।
অবস্থা বুঝতে দেরি করেননি CHO। ২০২৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর নাজমাকে অবিলম্বে হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানেই তাকে দেওয়া হয় অ্যান্টি-হাইপারটেনসিভ ওষুধ ও আইভি ফ্লুইড। চিকিৎসার পর শিশুর নড়াচড়া ফের শুরু হলেও পূর্বের জটিলতার কারণে চিকিৎসকরা ঝুঁকি নিতে চাননি। অবশেষে সম্প্রতি জরুরি সিজারিয়ান সেকশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অপারেশন সফল হয়—নাজমা একটি সুস্থ পুত্রসন্তানের জন্ম দেন।
পুত্র সন্তানের জন্মের চারদিন পর, মা ও শিশুকে সুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। আজ নাজমার বাড়িতে এখন শুধুই হাসি আর স্বস্তির ছোঁয়া।নাজমার পরিবার কৃতজ্ঞ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মীদের প্রতি। তাঁদের কথায়—“যদি আশা দিদি ও CHO মেমসাহেব ঠিকমতো খোঁজ না নিতেন, হয়তো এমন সুন্দর পরিণতি হতো না।”
নাজমার নিরাপদ প্রসবের এই যাত্রা তিনটি বিষয়কে সামনে আনে—সক্রিয় পর্যবেক্ষণ,নিয়মিত পরিচর্যা ও সময়মতো রেফারেল। এই তিনটি কারণেই একটি উচ্চঝুঁকির গর্ভাবস্থা রূপ নেয় সফল মাতৃত্বের ক্ষেত্রে। রাঙাউটি আয়ুষ্মান আরোগ্য মন্দিরের স্বাস্থ্যকর্মী রিম্মি চৌধুরী ও আশা কর্মী শিল্পী ধরের নিষ্ঠা দেখিয়ে দেয়—প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সঠিক ব্যবস্থাপনা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো পর্যবেক্ষণ আর দ্রুত সিদ্ধান্ত এক মা ও শিশুর জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে—নাজমার গল্পই তার প্রমাণ।