প্রতিনিধি অনুপম পাল, কৈলাসহর
আজ থেকে প্রায় ৯৬ বছর আগে, পার্বত্য ত্রিপুরার দুর্গম প্রান্তে, জঙ্গলাকীর্ণ ও অনুন্নত কৈলাসহরের বুকেই জন্ম নিয়েছিল এক যুগান্তকারী উদ্যোগ—শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম। ১৯২৯ সালে মাত্র দেড়শ টাকার বিনিময়ে ছয় কানি টিলা জমি ক্রয় করে শুরু হয়েছিল এই আশ্রমের যাত্রা। চারপাশে ঘন জঙ্গল, কাছেই শ্মশান—এমন নির্জন ও ভয়ানক প্রান্তরে গুরুকুল ধাঁচে শুরু হয়েছিল ঠাকুরঘর ও ছোট্ট ছাত্রাবাস নিয়ে আশ্রমের কার্যক্রম। এই উদ্যোগের পেছনে ছিলেন সমাজসেবায় নিবেদিত একদল মানুষ, যাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে স্মরণীয় ব্রজেন্দ্র দেব গুপ্ত (দাদাবাবু) ও কুঞ্জলাল চট্টোপাধ্যায়,রাজকীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও মাতা ঠাকুরবাণীর শিষ্য। তাঁদের হাত ধরেই কৈলাসহরে শিক্ষার এক নব অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। রামকৃষ্ণ আশ্রম শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছিল না—এটি ছিল শিক্ষা, সমাজসেবা ও মানবকল্যাণের এক কেন্দ্রবিন্দু। তৎ সময়ে আশ্রমের উদ্যোগে স্থাপিত হয় একাধিক নৈশবিদ্যালয়—কাচেরঘাট ও রাধাকিশোর ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে। শ্রীরামপুর এলাকায় শুরু হয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, যা পরবর্তীকালে শ্রীরামপুর উচ্চতর বিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। এইভাবে আশ্রম ধীরে ধীরে কৈলাসহরের শিক্ষার ভিত্তি মজবুত করে তোলে। তবে আশ্রমের পথ মসৃণ ছিলোনা। ব্রিটিশ আমলে আশ্রম পরিচালিত বিদ্যালয় একবার রহস্যজনক অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায়। কিন্তু দাদাবাবু ও তাঁর সহযাত্রীদের দৃঢ় প্রত্যয়ে থেমে থাকেনি শিক্ষার আলোকযাত্রা। ১৯৪২ সালে আশ্রম প্রাঙ্গণের এক গাছতলায় প্রতিষ্ঠিত হয় “রামকৃষ্ণ শিক্ষা সদন”—যা কৈলাসহরের আধুনিক শিক্ষার ইতিহাসে এক মাইলফলক। দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তুদের আগমন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এক উচ্চতর বিদ্যালয়ের প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন আবারও সমাজের প্রয়োজনে আশ্রম এগিয়ে আসে। ১৯৫০ সালে আশ্রমের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় রামকৃষ্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান—কৈলাসহরের শিক্ষার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা ঘটে এই বছরেই। সমাজের নানা শ্রেণির মানুষের জমিদান, মুষ্টিভিক্ষা, ও বিনা পারিশ্রমিকের শ্রমদানে গড়ে ওঠে এই শিক্ষালয়।এরপর ১৯৬৮ সালে সরকারী উদ্যোগে নির্মিত হয় বিদ্যালয়ের বর্তমান ইটের ভবন। গত ৫৭ বছর ধরে এই ভবনেই চলেছে শিক্ষার বিস্তার। যদিও বর্তমানে স্কুল ভবনটি জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে, তবুও এখানেই এখনো পাঠদান অব্যাহত আছে শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। রাজ্য সরকারের অর্থানুদানে ইতিমধ্যেই নতুন স্কুল বিল্ডিং নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে, যা সম্পূর্ণ হতে সময় লাগবে প্রায় দু’বছর। এরই মধ্যে বিদ্যালয় প্রবেশ করছে তার গৌরবময় ৭৫তম বর্ষে—যা সমগ্র কৈলাসহরবাসীর কাছে গর্বের বিষয়। প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর উদযাপন উপলক্ষে আশ্রম ও বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে চলছে প্রস্তুতির তুঙ্গ। পরিকল্পনা করা হয়েছে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী সম্মেলন, প্রদর্শনী ও সেবামূলক কর্মসূচি।
শিক্ষার পাশাপাশি আশ্রম সমাজসেবার ক্ষেত্রেও রেখেছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। ৯০ বছর আগে যখন কৈলাসহরে কোনো হাসপাতাল ছিল না, তখন আশ্রমের উদ্যোগেই স্থাপিত হয়েছিল হোমিওপ্যাথি ধাতব্য চিকিৎসালয়, যেখানে অসহায়দের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হতো। এমনকি ছোঁয়াচে রোগীদেরও আশ্রমে রেখে সেবাশুশ্রূষা করতেন কর্মীরা। তাছাড়া জাতপাতের ভেদাভেদ দূরীকরণেও আশ্রমের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। উৎসবের দিনে উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ নির্বিশেষে সকলেই একত্রে প্রসাদ গ্রহণ করতেন—যা সে সময়ের সমাজে ছিল এক বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ।আজকের আধুনিক কৈলাসহর যে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবতার আলোয় আলোকিত, তার মূল প্রেরণার অন্যতম উৎস নিঃসন্দেহে শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম ও রামকৃষ্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। প্রায় এক শতাব্দী ধরে এই প্রতিষ্ঠান শুধু জ্ঞান নয়, মানবতার বীজ বপন করে চলেছে অবিরত। কৈলাসহরের ইতিহাসে রামকৃষ্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেবল একটি বিদ্যালয় নয়—এটি এক যুগের চেতনা, সমাজসেবার প্রতীক এবং ত্রিপুরার শিক্ষাজাগরণের অমলিন আলোকস্তম্ভ। ৭৫ বছরের এই ঐতিহ্য শুধু অতীতের গৌরব নয়, আগামী দিনের অনুপ্রেরণাও।