
Oplus_0
সংবাদ প্রতিনিধি । অনুপম পাল । কৈলাসহর
ছোট একটি কুঁড়েঘর। কৈলাসহর পুর পরিষদ এলাকার সোনামারার ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ছেঁড়া ছাউনি, ভেজা উঠোন, আর ভেতরে এক মেয়ে—যার চোখে ভেসে ওঠে অদেখা স্বপ্ন। সেই মেয়ের নাম দেবশ্রী ঘোষ। বয়সে তরুণী, কিন্তু মানসিকতায় লড়াকু এক যোদ্ধা। আর তার পেছনে যে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছেন, তিনি তার মা—চম্পা গোপ (ঘোষ)। সমাজের ধূলিধুসর পথ বেয়ে, অসম্মান আর অবহেলার আগুনে পুড়ে যিনি গড়ে তুলেছেন নিজ কন্যার ভবিষ্যৎ।
২০০৭ সালে সামাজিক রীতিনীতি মেনে কমলপুরের সুরঞ্জন ঘোষের সঙ্গে চম্পার বিবাহ হয়। কিছুদিন গড়াতেই সংসারে নেমে আসে অশান্তির কালো মেঘ। কটূ কথা, গালিগালাজ, অপমান—সবকিছু সহ্য করেও চম্পা বুকের মধ্যে আশা বয়ে চলেছিলেন। কিন্তু অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় একদিন সব সহ্যের বাঁধ ভেঙে গেলে ফিরে আসেন কৈলাসহরের বাবার বাড়িতে।
২০০৮ সালের অক্টোবর মাস। কৈলাসহর আরজিএম হাসপাতালে জন্ম নেয় একটি কন্যাসন্তান—দেবশ্রী। জন্মের পর আশায় বুক বেঁধে মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বামীর দরজায়। কিন্তু ফিরিয়ে দেন স্বামী! স্ত্রীকে দেখেই তার বক্তব্য—“এই মেয়ে আমার নয়।”চোখে জল নিয়ে একমাসের মেয়েকে কোলে নিয়ে আবার ফিরে আসেন কৈলাসহর তার বাপের বাড়ি।
সেই দিন থেকে শুরু হয় এক মায়ের একার সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামের হাত ধরেই বড় হতে থাকে দেবশ্রী। মায়ের আঁচলই হয়ে ওঠে তার বিদ্যালয়, তার খাতা-কলম, তার সাহস। লক্ষীনারায়ণ বাড়ি জেবি স্কুল থেকে পড়াশোনার হাতেখড়ি, তারপর সাফল্যের পথ বেয়ে এবার মাধ্যমিকে ৭০.২০% নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে দেবশ্রী। বর্তমানে সে ভগিনী নিবেদিতা উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে শুরু করেছে।
তবে দেবশ্রীর এই উত্তরণ শুধু স্কুলের পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আসলে সেই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার গল্প—যেখানে প্রতিটি পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে চায়ের কাপ বিক্রির টাকায়।
চম্পা দেবী সকাল থেকে সন্ধ্যা—বৃষ্টি হোক বা তীব্র রোদ—কৈলাসহরের অলিগলি ধরে ঘুরে বেড়ান চায়ের জার হাতে। মুখে একটাই কথা—“মেয়েকে মানুষ করতে হবে। আমি না খেয়ে থাকবো, তবু ওকে পড়াব।”
আজ দেবশ্রী নিজের চেষ্টায় স্কুলে নজর কাড়ছে। কিন্তু সামনে প্রশ্ন—এই পথ কতদূর যাবে? বিজ্ঞান পড়া, কোচিং, বই, এক্সট্রা ক্লাস—সবই টাকার প্রশ্ন। আর সেই টাকা আসে প্রতিদিনের চায়ের বিক্রিতে।চম্পার চোখে এখন উদ্বেগ—মেয়েকে কতদিন এইভাবে পড়াতে পারবেন? হয়তো আর কিছুদিন, তারপর… তারপর?
তিনি সমাজ, সরকার, সহৃদয় মানুষজনের দিকে তাকিয়ে আছেন—কেউ যদি এই মেয়েটির জন্য একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, তবে সে পৌঁছতে পারে আরও অনেক উঁচুতে, যেখানে হয়তো একদিন দাঁড়িয়ে সে বলবে—”আমার মা-ই আমার পৃথিবী।”